অধরা সিদ্দিকুরের দুর্দশায় দায়ী পুলিশরা

বিক্ষোভে নেমে চোখ হারানো সিদ্দিকুর রহমানের দুর্দশার জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। তদন্ত প্রতিবেদনে কাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেই তথ্য গণমাধ্যমে নানা সূত্রে প্রকাশ হলেও সেই তথ্যও প্রকাশ করছে না বাহিনীটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজে পরীক্ষার রুটিনের দাবিতে আন্দোলনে নেমে গত ২০ জুলাই চোখ হারান সিদ্দিকুর। শাহবাগে তাদের মিছিলে ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল গিয়ে সরাসরি লাগে সিদ্দিকুরের চোখে। এই ঘটনার ভিডিও প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে দায়ীদের চিহ্নিত করতে গত ২৩ জুলাই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। কমিটিতে ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) মীর রেজাউল আলম, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার আশরাফুল আলম।

সিদ্দিকুরের এই ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি পেতে হবে-জোরের সঙ্গে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের এই বক্তব্যের পর গত ২৫ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, পুলিশের তদন্তে সত্য উদঘাটন না হলে আবার তদন্ত করা হবে।

মন্ত্রী সেদিন বলেন, ‘পুলিশ প্রধান সিদ্দিকুরের ওপর হামলার ঘটনায় তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে কমিটি যদি সত্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা আবারো কমিটি করব।’

আলোচিত সেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে গত ৭ আগস্ট। কিন্তু এ নিয়ে তা তদন্ত কমিটির সদস্য, না ঢাকা মহানগর পুলিশ, না পুলিশ সদরদপ্তর-কেউই মুখ খুলছে না। যদিও পুলিশের সূত্রে গণমাধ্যমে দায়ীদের নাম চলে এসেছে। এসব প্রতিবেদনের কোনো প্রতিবাদও দেয়নি পুলিশ।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক, খুব কাছ থেকে ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল সিদ্দিকুর রহমানের চোখে লাগে বলে তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় চিহ্নিত সাতজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদন অভিযুক্ত করা হয়েছে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু জাফর আলী বিশ্বাস ও পরিদর্শক (অভিযান) আবুল কালাম আজাদ এবং দাঙ্গা দমন বিভাগের (পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট-পিওএম) পাঁচ কনস্টেবলকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘দাঙ্গা দমন বিভাগের পাঁচ কনস্টেবল ছিলেন আক্রমণাত্মক। তাঁরা হঠাৎ করেই শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন। তাঁদের একজন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি খুব কাছ থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়েন। এটি তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানের চোখে লাগলে তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘটনাস্থলের কাছে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু জাফর আলী বিশ্বাস ও পরিদর্শক (অভিযান) আবুল কালাম আজাদ থাকলেও তাঁরা পুলিশ সদস্যদের নিবৃত্ত করেননি। এমনকি তাঁরা পুলিশ সদস্যদের সঠিক নির্দেশনাও দেননি। পুলিশ সদস্যরা অপেশাদারসুলভ আচরণ করেন।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চিহ্নিত করে দিয়েছি, এখন বাকি কাজ ডিএমপি করবে। এখানে আমাদের কোনো দায় বা দায়িত্ব নেই।’

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসান নিশ্চিত করেছেন তদন্তে নাম আসা তার থানার দুই কর্মকর্তা এখনো স্বপদে বহাল। কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’

সেই দিনের সেই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে তার নাম আসার বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু জাফর আলী বিশ্বাস বলেন, ‘আপনি তদন্ত কমিটির কারো সঙ্গে কথা বলেন। আমি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’

অপর পুলিশ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’

পুলিশের দাঙ্গা দমন বিভাগের (পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট-পিওএম) পাঁচ কনস্টেবলের বিরুদ্ধেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানায়নি সংস্থাটি।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার তিন সপ্তাহেও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার ইউসুফ আলী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। পরে খোঁজখবর নিয়ে আপনাকে জানাতে পারব।’

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি তার মুঠোফোনটি রিসিভ করেননি।

যেমন আছেন সিদ্দিকুর

চোখে আঘাতের পর পর সিদ্দিকুরের ডান চোখের আলো পুরোপুরি নিভে যায়। বাম চোখে খানিক আশা দেখছিলেন চিকিৎসকরা। এজন্য চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে এক দফা অস্ত্রোপচারও করা হয়। কিন্তু সুফল মেলেনি। পরে ভারতের চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে পাঠানো হয় তাকে। সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অস্ত্রোপচার করলে সুফল মেলার সম্ভাবনা কম জানান। তারপরও সিদ্দিকুরের আগ্রহের কারণে অস্ত্রোপচার করা হয়। আর অস্ত্রোপচার শেষে ১১ আগস্ট দেশে ফেরেন তিনি।

দেশে আসার পর থেকে সিদ্দিকুর চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটেই ভর্তি আছেন। তার বন্ধু শেখ ফরিদ জানান, বাম চোখে সিদ্দিকুর দেখতে পান না এখনো। তবে তিনি আলোর অনুভূতি বুঝতে পারেন।ঢাকাটাইমস।