অপহৃত সেই ব্যাংক কর্মকর্তা বাসায় ফিরলেও মুখ খুলছেন না

রাজধানীর পুরানা পল্টন থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে ‍অপহরণের পাঁচদিন পর ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম আহমেদকে ফিরিয়ে দিলেও কারা,কেন তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তা জানা যায়নি। পরিবারের কাছেও তিনি এ বিষয়ে মুখ খুলেননি। কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলছেন না। বাসায় ফিরে বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন নামাজ পড়ে। পল্টন থানা পুলিশ বলছে, তারা এখনও অপহরণের বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি।

পুরানা পল্টনের ‘খানা বাসমতি’ রেস্তোরাঁর সামনে থেকে গত ২৩ আগস্ট অপহৃত হন আইএফআইসি ব্যাংকের করপোরেট কমিউনিকেশন অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদ। সোমবার (২৮ আগস্ট) রাতে তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় মতিঝিলে ফেলে যায় অপহরণকারীরা। দিনেদুপুরে জোর করে কালো কাচের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর শামীম আহমেদের পরিবারের সঙ্গে অপহরণকারীরা মুক্তিপণ বা অন্য কিছু চেয়ে যোগাযোগও করেনি। পাঁচদিন পর আবার তাকে ফিরিয়ে দেওয়ায় সব মিলিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

শামীম আহমেদের স্ত্রী শিল্পী আহমেদ মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) বলেন, ‘ফিরে আসার পর কারা অপহরণ করেছিল, কেন করেছিল- এ বিষয়ে কিছু বলেননি শামীম। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছেন কম। ফিরে আসার পর রাতের বেশিরভাগ সময় নামাজ পড়ে কাটিয়েছেন তিনি।’

শামীম আহমেদের পরিবার ও পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ২৮ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে চোখ বাঁধা অবস্থায় শামীমকে মতিঝিলে ফেলে যায় অপহরণকারীরা। এরপর তিনি যান শান্তিনগরে এক আত্মীয়ের বাসায়। সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় থাকা স্ত্রী শিল্পী আহমেদকে ফিরে আসার খবর জানান। রাতেই স্ত্রী-সন্তানেরা ঢাকায় আসেন। রাত ১১টার দিকে অপহরণের অভিযোগে করা জিডির তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার এসআই সাইদুল ইসলামকে শামীমের ফিরে আসার বিষয়টি জানানো হয়।

মঙ্গলবার পল্টন থানায় বসে কথা হয় শিল্পী আহমেদের। তিনি জানান, শামীম আহমেদের থানায় আসার কথা থাকলেও শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় তিনি আসতে পারেননি। শিল্পী আহমেদ জানান, ফিরে আসার পর থেকে শামীম আহমেদ তেমন কথা বলছেন না। সোমবার রাতের বেশিরভাগ সময় নামাজ পড়ে কাটিয়েছেন। তেমন কথা না বললেও বারবার মেয়েদের আদর করছিলেন তিনি। অপহৃত থাকা অবস্থায় তার স্বামীকে কোনও নির্যাতন করা হয়নি জানিয়ে শিল্পী আহমেদ বলেন, ‘আমাদেরকে তিনি বন্দি অবস্থা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলেননি। তবে তাকে কোনও ধরনের নির্যাতন করা হয়নি বলে জানিয়েছেন। তারা তাকে নিয়মিত খাবারও দিয়েছে। তার শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই।’

কারা, কেন অপহরণ করেছিল- এ ব্যাপারে শামীম আহমেদ কিছু বলেছেন কিনা এমন প্রশ্নে তার স্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ওই সময় তিনি এ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলতে চাননি। তার কোনও শত্রু নেই। কারও সঙ্গে ঝামেলাও নেই। কিন্তু কেন তাকে অপহরণ করা হলো সেটা আমরাও বুঝতে পারছি না। তবে আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া তিনি আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছেন। আমরা এর বেশি কিছু চাই না। সুনির্দিষ্ট কারও বিরুদ্ধে আমাদের কোনও অভিযোগও নেই।’

এদিকে, শামীম আহমেদকে কেন অপহরণ করা হয়েছিল সে বিষয়ে এখনও কিছু বলতে পারছে না পুলিশ। অপহরণের পর পল্টন থানায় শিল্পী আহমেদের দায়ের করা সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্তে থাকা এসআই সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘ফিরে আসার পর শামীম আহমেদের স্ত্রীর মাধ্যমে আমি খবর পেয়েছি। রাতেই শামীম আহমেদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় তিনি কথা বলতে চাননি। এরপর আজকে তাকে থানায় নিয়ে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু আজকেও তিনি আসেননি। তার স্ত্রী এসেছেন। ফলে যে ভিকটিম– তার সঙ্গে কথা বলতে না পারলে মূল বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন।’ এসআই আরও বলেন, ‘আমরা শামীম আহমেদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। প্রয়োজনে তার বাসায় গিয়ে কথা বলবো। এখন তিনি ও তার পরিবার যেভাবে চাইবেন আমরা সেভাবেই তাদের সহায়তা করবো।’

৬১, পুরানা পল্টন আইএফআইসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ৯০ কদম পশ্চিমে অবস্থান হোটেল ‘খানা বাসমতি’র। ২৩ আগস্ট দুপুরে এই হোটেলের সামনে থেকে অপহৃত হন আইএফআইসি ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম আহমেদ। অন্তত ৯জন অপহরণকারী এতে অংশ নেয়।

হোটেল কর্তৃপক্ষ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হোটেলের সামনে প্রায় ২ ঘন্টা ধরে কালো কাচের সাদা রংয়ের একটি মাইক্রোবাস দাঁড়ানো ছিল। দুপুর ১টা ১০ মিনিটের দিকে দুজন হোটেলে এসে নিচতলার মাঝামাঝি স্থানের দুটি টেবিল বুক করেন। এরপর পূর্বনির্ধারিত টেবিলে না বসে হোটেলে প্রবেশের পর প্রথম দুটি টেবিলে ৯জন বসে খাওয়া দাওয়া করেন। রেস্তোরাঁর ওয়েটার ময়নাল হোসেন জানান, খাওয়ার পর তারা তিন হাজার ৩৪০ টাকার বিল পরিশোধ করেন।

রেস্তোরাঁর সামনে থেকে শামীম আহমেদকে গাড়িতে তুলে নেওয়ার সময় সেখানে দায়িত্বে ছিলেন নিরাপত্তারক্ষী আহম্মদ আলী ও বাহাদুর। আহম্মদ আলী বলেন, ‘প্রায় দুই ঘণ্টা সাদা রঙের একটা মাইক্রোবাস হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মাইক্রোর লোকজন হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে। দুপুর দেড়টার কিছু পর হোটেলে দিকে আসার সময় একজনকে তারা জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। শুরুতে আমরা কাকে নিয়ে গেছে চিনতে পারিনি। পরে জানতে পেরেছি উনি আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা।’

অপহরণকারীরা যে দুই টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খেয়েছিল তার উপরে দুই পাশে দুটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এই দুটি ক্যামেরাসহ হোটেলের ভেতরে মোট আটটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। অপহরণকারীদের স্পষ্ট ছবি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে রয়েছে বলে জানান রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা।

পরিকল্পিতভাবে অপহরণ, কোনও নির্যাতন না করা, পরিবারের কাছে মুক্তিপণ বা অন্য কিছু চেয়ে যোগাযোগ না করা, অবশেষে পাঁচদিন পর চোখ বেঁধে ফেলে যাওয়া– এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জিডির তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার এসআই সাইদুল ইসলাম।-প্রতিবেদন বাংলাট্রিবিউনের সৌজন্যে প্রকাশিত।