অভাব আর মানসিক যন্ত্রণা থেকেই মা-মেয়ের আত্মহত্যা

আর্থিক অনটন আর প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্থ ছিলেন শ্যামলী বসাক। স্বামীর ঘর ছেড়ে বাবার বাড়িতেও আশ্রয় হয়নি তার দেড় বছরের মেয়ে মনি বসাককে নিয়ে। এরপর পাশেই নানি বাড়িতেই ছিলেন সর্বশেষ। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই জীবন সংগ্রামে পরাজিত এই মা তার প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

শনিবার দুপুরে পঞ্চগড় সদরের ধাক্কামারা ইউনিয়নের বকুলতলায় চলন্ত ট্রেনের নিচেই খুঁজে নিয়েছেন শেষ আশ্রয়। ঘটনাটি জেলাসহ সারাদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

রোববার সরেজমিন শ্যামলী বসাকের গ্রাম বসাকপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল তাদের পরিবারের দৈন্যদশা। স্বামীর ঘর ছেড়ে যে বাবার বাড়িতে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলেন শ্যামলী, সেখানে একটি মাত্র শোয়ার ঘর। এই ঘর থেকে শ্যামলীর বাবা অরুন বসাক ৪ মেয়ের মধ্যে ৩ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই মেয়ে স্বামীর বাড়িতে সংসার করছেন। তিন বছর আগে বিয়ে হওয়া শ্যামলীর স্বামী প্রদীপ চন্দ্রের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বিয়ের ৬ মাসের মাথায় বাবার বাড়ি চলে আসেন। শ্যামলীর বাবা পেশায় একজন দিনমুজুর। ছোট মেয়ে বিথী বসাক স্থানীয় একটি স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তাদের ভরণপোষণ করাই অরুন বসাকের পক্ষে কঠিন ছিল। তার সঙ্গে শ্যামলী এবং তার প্রতিবন্ধী মেয়ে মনি বসাকের ভরণপোষণের পাশাপাশি থাকার ব্যবস্থা নিয়ে ছিল জটিলতা। সঙ্গত কারণেই বাবার সংসারে বেশিদিন থাকা হয়নি শ্যামলীর।

শ্যামলী বসাকের বাবা অরুন বসাক বলেন, প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে স্বামীর ঘরে যেতে চাননি শ্যামলী। তার স্বামী প্রদিপ একাধিকবার তাকে নিতে এসেছিলেন। আমার আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। ছোট মেয়ে নিয়ে একটি ঘরে স্ত্রীসহ বসবাস করি। শ্যামলী একটু জেদি ছিল। নিজেই যা বুঝতো, তাই করতো। কিন্তু সে যে মেয়ে নিয়ে আত্মহত্যা করবে সেটা চিন্তাও করিনি।

শ্যামলীর মা ফন্দি বসাক বলেন, প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল শ্যামলী। মেয়েটি শুয়ে অথবা বসে থাকতে পারতো না। সারাক্ষণ কোলে করে নিয়ে বেড়াতে হতো। তার চিকিৎসার জন্য নিয়মিত পঞ্চগড়ে যেতো। শনিবারও যখন যায়, তখন আমি মা এবং মেয়ের হাসিমুখ দেখেছি। ফেরত আসার সময় কীভাবে কি করলো বলতে পারছি না।

তার বাড়ি থেকে চার বাড়ি পরেই নানি বাড়ি। সর্বশেষ সেখানেই বসবাস শুরু করেন শ্যামলী। তবে নিজের সংসার চালাতে স্থানীয় একটি এনজিওর শিশুশিক্ষা প্রকল্পে (সোভা আদর্শ শিক্ষা নিকেতন) ১৮শ টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। প্রতিবন্ধী মেয়েকে কখনও কোলে নিয়ে, কখনও পাশে শুইয়ে দিয়ে শিক্ষকতা করতেন। পাশপাশি একটি সেলাই মেশিন ছিল তার। এই আয় দিয়ে কোনোমতে চলতো তার থাকা খাওয়া। কিন্তু বড় বিপর্যয়ে পরেন প্রতিবন্ধী মেয়ের চিকিৎসা নিয়ে।

আটোয়ারী উপজেলার বসাকপাড়া থেকে ১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে পঞ্চগড় শহরের প্রতিবন্ধী পরিচর্যা কেন্দ্রে যেতেন মেয়ের চিকিৎসার জন্য। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও আর্থিক সহযোগিতা পাননি কারও।

তবে শ্যামলী বসাকের মামা বিমল বশাক বলেন, শ্যমলী স্বামীর বাড়িতে আশ্রয় পায়নি। বাবার বাড়িতেও থাকার ব্যবস্থা ছিল না। তিনি দাবি করে বলেন, আমাদের বাড়িতে তার থাকা এবং খাওয়ার কোনো অসুবিধা ছিল না। আমার বাবা (শ্যামলীর নানা) তার মেয়ের চিকিৎসার খরচও বহন করতো। সে মূলত প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়েই বেশি যন্ত্রনায় ছিল। সে এভাবে চলে যাবে কখনও বুঝতে দেয়নি।

আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বসাকপাড়ায় প্রায় ৫০টি পরিবার রয়েছে। তাদের সকলে এক সময় বসাক জাতী তথা তাঁতি ছিলেন। কালের বিবর্তনে সেই পেশা হারিয়ে তাদের অনেকেই এখন দিনমজুরি করে দিনযাপন করেন। অরুন বসাকের পরিবার ছিল তাদের একজন। এজন্য পারিবারিক বা সামাজিক কোনো সহয়তা না পেয়ে জীবন যুদ্ধে হেরে যান শ্যামলী। বসাকপাড়ার বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।

শ্যামলী বসাকের প্রতিবেশীরা জানায়, সে খুব ভালো মেয়ে ছিল। কি কারণে স্বামীর বাড়িতে বনিবনা হয় তা জানা জায়নি। তবে তার স্বামী তাকে নিতে এসেছিল। এজন্য তিনি স্ত্রী ফেরত পাওয়ার জন্য ঠাকুরগাও কোর্টে একটি মামলাও করেন। কিন্তু মামলার শুনানির সময় শ্যামলী অজ্ঞাত কারণে স্বামীর বাড়িতে যেতে আদালতে অমত প্রকাশ করেন। পরে অবশ্য শ্যামলী বসাকের পরিবারের পক্ষ থেকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে ভরণ পোষণের একটি মামলাও করেন। মামলাটি এখনও বিচারাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রতিবেশি হরেন বসাক বলেন, সে সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলতো। বিয়ের পর কেন একাই থাকতো জানি না। তবে মেয়েটির জন্মের পর থেকে তার চিকিৎসার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তার মনের কষ্ট আমরা বুঝতে পারিনি।

স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা সোভা’র মাঠকর্মী বেলাল হোসেন বলেন, আমাদের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে তিনি ভালোই ছিলেন। পাশাপাশি নিজের মেশিনে সেলাইয়ের কাজ করতেন। তিনি সবকিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। তবে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে সব সময় বিপর্যস্থ মনে হতো তাকে।

শ্যামলীর স্বামী প্রদিপ চন্দ্র পেশাগত কারণে সিলেটে থাকেন। সেখানে একটি অটোরাইস মিলে শ্রমিকের কাজ করেন। তার দাবি, সে একাধিকবার স্ত্রীকে নিতে আসেন। কিন্তু তার স্ত্রী যায়নি। কোনো একদিন ফেরত আসবে এই আশায় এখনও বিয়ে করেন নি তিনি। তবে স্ত্রী এবং মেয়ের আত্মহত্যার খবরেও তিনি কর্মস্থল থেকে বাড়িতে আসেননি।

শ্যামলীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি গিয়ে আর কি করবো। আপনারা যেমন ভালো মনে করেন, সেটাই করেন। অবশেষে শনিবার গভীররাতে বাবাকে ছাড়াই দেড় বছরের মেয়ে মনি বসাক এবং তার মা শ্যামলী বসাককে দাহ করা হয়।

শ্যামলীর স্বামী প্রদিপ চন্দ্র মোবাইল ফোনে বলেন, শ্যামলী আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমি স্বামীর ঘর করবো না, স্বামীর ভাতও খাব না।’ এরপর থেকে আমি তার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। মেয়ে এবং স্ত্রীকে শেষ বারের মতো দেখতে আসলেন না কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ছুটি পাইনি। এজন্য ইচ্ছা থাকা সত্বেও যেতে পারিনি।

এদিকে পার্বতীপুর থেকে ছেড়ে আসা পঞ্চগড়গামী ট্রেনে আত্মহত্যার দেড়ঘণ্টার মাথায় একই ট্রেন আবারও তাদের মরদেহের উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়া হয়। ২য় বার ট্রেনে কাটা পরে ছিন্ন ছিন্ন হয়ে যায় মা ও মেয়ের মরদেহ। এ নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা গেছে স্থানীয়দের মাঝে। তারা ওই ট্রেন চালকের উপযুক্ত বিচার দাবি করেছেন।

ঘটনাস্থল বকুলতলা এলাকার সফিকুল ইসলাম বলেন, মা এবং মেয়ের মরদেহ রেললাইনের উপর পরেই ছিল। পরে যখন ট্রেন ফেরত আসছিল। আমরা সকলেই হাত উচু করে ট্রেন থামাতে অনুরোধ করি কিন্তু ট্রেন মরহেরে উপর দিয়ে চলে যায়।

আর্থিক অনটন, সুচিকিৎসার অভাব এবং প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্থ ছিলেন শ্যামলী। এজন্য তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন বলে মনে করেন জনপ্রতিনিধি ও মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওমর আলী।

তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুর প্রতিবন্ধী কার্ড ছিল। তবে বয়সের কারণে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া যায়নি। তবে তাকে ভিজিডি কার্ড দেয়া ছিল। এই কার্ডে তিনি প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল পেতেন।