‘আত্মতৃপ্তি’ নিয়ে গেলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রথম নারী বিচারক

উচ্চ আদালতে একটি ইতিহাসের ইতি ঘটলো। অবসরে গেলেন দেশের ইতিহাসে উচ্চ আদালতের প্রথম নারী বিচারক নাজমুন আরা সুলতানা। শেষ কর্মদিবস ৭ জুলাই শুক্রবার হওয়ায় আজই তিনি শেষ বিচারকাজ পরিচালনা করলেন।

শেষ কর্মদিবসে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি তাকে সংবর্ধনা দিয়েছে।দুপুরে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এ বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়া হয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন নারী এ বিচারপতির বর্ণাঢ্য কর্মময়জীবন নিয়ে বক্তব্য দেন। এছাড়া আজ বিকালে জাজেস লাউঞ্জে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা তাকে সংবর্ধনা দেবেন।

প্রায় ৪২ বছরের বিচারক জীবনের স্মৃতিচারণ করেন আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমি আত্মতৃপ্তি নিয়ে বিচারঙ্গন থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি আমার সুদীর্ঘ বিচারক জীবনে কখনোই জেনেবুঝে বা অবহেলা করে বা অমনোযোগী হয়ে কোনো ভুল বিচার বা অন্যায় বিচার করিনি। আমার অনেক বিচারই হয়তো ভুল হয়ে গেছে, আপিলে গিয়ে হয়তো সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু সে ভুল বিচার আমি জেনে বুঝে বা অমনোযোগী হয়ে করিনি। জেনে বুঝে অবিচার করা বা অমনোযোগী হয়ে বা অবহেলা করে ভুল বিচার করা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।’

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘পক্ষাশ্রিত হয়ে বা কোনো কারণে বা কারো দ্বারা প্রভাবান্নিত হয়ে বিচার করা মহাপাপ। আমার আত্মতৃপ্তি, আমি জেনে বুঝে বা অবহেলা করে বা অমনোযোগী হয়ে বা পক্ষাশ্রিত বা প্রভাবিান্নিত হয়ে ভুল বিচার, অন্যায় বিচার করিনি কখনোই।’

স্মৃতিচারণ করে আপিল বিভাগের এ বিচারপতি বলেন, ‘প্রায় ৪২ বছরের বিচারকের জীবন আমার শেষ হলো আজ। বিচার করার কঠিক কাজ ও বিচারকের সীমাবদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার আগ্রহ ছিল আমার। আজকের এ ক্ষণটিতে আমার কষ্ট হচ্ছে, এই বিচার অঙ্গন থেকে বিদায় নিতে, আপনাদের ছেড়ে যেতে।’

বিদায়ী বিচারপতি বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে বিচারক বানিয়েছেন, এদেশের প্রথম নারী বিচারক। তবে আমার বিচারক হওয়ার পেছনে আমার মরহুম আব্বার ইচ্ছা ও আম্মার প্রেরণা বড় ভূমিকা রেখেছে।’

১৯৭২ সালের আইনজীবী পেশার প্রথমদিন কোর্টের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বোধহয় আমার মনের কোণায় ইচ্ছাটা উঁকি দিয়েছিল, আমি কি জজ হতে পারি না? কিন্তু জানলাম আমি জজ হতে পারি না। ওই সময় বাংলাদেশের নারীরা জজ হতে পারতো না। আমি ওকালতি করার বছর দেড়েক পরে ওই বিধান সরকার তুলে দেয়।’

বিচারক বলেন, ‘১৯৭৫ সনের শেষের দিকে দেশের প্রথম নারী বিচারক হয়ে খুলনার জজশিপে ‍মুন্সেফ হিসেবে যোগদান করি। ওই সময়ে খবরের কাগজে এটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল। প্রতিক্রিয়া দুরকমেরই হয়েছিল। কেউ স্বাগত আবার অনেকে নাক সিঁটকেছিলেন, নারী আবার বিচারক হতে পারে নাকি, নারী আবার কী বিচার করবে? কর্মক্ষেত্রে আমি এই দুরকমের আচরণ পেয়েছিলাম।’

প্রথম নারী বিচারক হিসাবে ব্যর্থ হয়ে যাইনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্রথম নারী বিচারক হিসেবে আমি ব্যর্থ হলে হয়তো আজ বাংলাদেশের প্রায় ৪০০ নারী বিচারক হতো না।’

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। বাবা আবুল কাশেম মঈনুদ্দীন ও মাতা বেগম রশীদা সুলতানা দীন। তিনি ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭২ সালে এলএলবি পাস করেন। একই বছর তিনি ময়মনসিংহ জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ (সহকারী জজ) হন। দেশ ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে তিনি প্রথম নারী বিচারক হিসেবে কাজে যোগদান করেন। ১৯৯১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা জজ হিসেবে নিয়োগ পান। এটাও ছিল প্রথম কোনো নারীর জেলা জজ হওয়ার ঘটনা। ২০০০ সালের ২৮ মে তিনি হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর দুই বছর পর হাইকোর্টে স্থায়ী হন তিনি। হাইকোর্টেও তিনি প্রথম বিচারপতি। ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। ২০১৩ সালের ০১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চের নেতৃত্বে বসান বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে।

বিচারিক কাজের পাশাপাশি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলাতানা প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ওমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের। দুই বার সেক্রেটারি ছিলেন ইন্টারন্যাশ অ্যাসোসিয়েশন অব ওমেন জাজেসের। বিশ্বের ৮২টি দেশে যে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো।