‘আমরা বাঙালি নই, আমাদের কেন স্কুলে বাংলা শিখতে হবে’

চা উৎপাদনের জন্য ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত একটি অঞ্চল দার্জিলিং এখন রীতিমত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে সেখানে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর।

দার্জিলিং এর নেপালি ভাষী গোর্খারা সেখানে নতুন করে এই দাবিতে আন্দোলন শুরু করার পর পরিস্থিতি দমনে সেখানে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছে। সহিংসতায় এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচজন নিহত এবং একশোর বেশি আহত হয়েছে।

এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তারা অভিযোগ করছে পুলিশ সেখানে গুলি চালিয়ে বিক্ষোভকারীদের হত্যা করছে। পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দার্জিলিং এর পাহাড়ে নতুন করে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠার কারণ কী?

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক নির্দেশ জারি করে দার্জিলিং-সহ রাজ্যের সব স্কুলে বাংলা ভাষা শেখানো বাধ্যতামূলক করে। বলা হচ্ছে, সরকারের এই নির্দেশই দার্জিলিং-এ বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। উল্লেখ্য দার্জিলিং এর সংখ্যাগরিষ্ঠ গোর্খাদের মাতৃভাষা হচ্ছে নেপালি।

“আমরা বাঙালি নই। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা নয়। দার্জিলিং এর প্রায় সবাই কথা বলে নেপালি ভাষায়। কাজেই আমাদের কেন জোর করে স্কুলে বাংলা শেখানো হবে?”, প্রশ্ন তুলেছেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রধান বিমল গুরুং।

মাসব্যাপী প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ডাক দেয়ার পর থেকে বিমল গুরুং এখন গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তাদের ডাকা ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে দার্জিলিং। এর ফলে বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার পর্যটক। বছরের এই সময়কে দার্জিলিং এ পর্যটন মওসুমের সবচেয়ে ব্যস্ত সময় বলে গণ্য করা হয়। বিমল গুরুং হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, পর্যটকদের যদি সেখানে থাকতে হয়, তাদের নিজের দায়িত্বে থাকতে হবে।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। রাজ্য পুলিশ নিয়মিত বিক্ষোভকারীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে, তাদের বাড়িঘর-অফিসে হানা দিচ্ছে। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা সরকারি অফিস-আদালতে আগুন দিচ্ছে, পুলিশেও ওপর হামলা চালাচ্ছে এবং দোকানপাট বন্ধ রাখার জন্য ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।

লড়াকু সৈনিক হিসেবে গোর্খাদের সুনাম আছে ব্রিটিশ, ভারতীয় এবং নেপালি সেনাবাহিনিতে। তাদের রণহুংকার ”জয় মহাকালী, আয়ো গোর্খালি”তে একখন প্রকম্পিত দার্জিলিং এর রাস্তাঘাট। পুলিশ কর্মকর্তা অনুজ শর্মা অভিযোগ করছেন, গোর্খারা বহুদিন ধরেই এরকম একটা সহিংস বিক্ষোভের জন্য প্রস্তুতি চালাচ্ছে। সেজন্যেই তারা বিস্ফোরক এবং অস্ত্র মওজুদ করছে তাদের গোপন আস্তানায়।

পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরও অভিযোগ করছেন, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বিমল গুরুং এর সমর্থকদের যোগাযোগ আছে। কিন্তু বিমল গুরুং এবং তাঁর সমর্থকরা এসব অভিযোগ ”রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে নাকচ করে দিয়েছেন।

গণমুক্তি মোর্চার একজন নেতা অমর সিং রাই বলেছেন, রাজ্য পুলিশ তাদের আন্দোলন দমনের জন্য ব্যাপক দমন অভিযান চালাচ্ছে। এর একটা পাল্টা প্রতিক্রিয়া তো হবেই। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোন আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেছেন, “আমরা কেবল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গেই আলোচনায় বসতে চাই এবং সেখানে কেবল আলোচনা হতে পারে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি নিয়ে।”

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং অবশ্য দুই পক্ষকেই সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে তিনি ত্রিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন।

ভারতের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে আশংকা বাড়ছে যে দার্জিলিং এর উত্তেজনাকে চীন তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। ভারতের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক উপ প্রধান মেজর জেনারেল গগনজিৎ সিং বলেন, “গোর্খারা সাংঘাতিক যোদ্ধা এবং দার্জিলিং-এ প্রচুর প্রশিক্ষিত সাবেক সেনা রয়েছে। যদি সেখানে কোন বিদ্রোহ শুরু হয়, সেটা ভারতের জন্য সামাল দেয়া সহজ হবে না।”

দার্জিলিং এ ১৯৮০ সালেও পৃথক রাজ্যের দাবিতে ভয়ংকর বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। তখন সেখানে প্রায় বারোশো মানুষ নিহত হয়। দার্জিলিং এ কিছুটা স্বায়ত্বশাসনের অঙ্গীকারের পর গোর্খারা তখন তাদের আন্দোলন থামিয়েছিল।

কিন্তু সেসময়ের গোর্খা নেতা সুভাস ঘিসিং এর জায়গায় এখন গোর্খাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিমল গুরুং, যাকে অনেক কট্টরপন্থী বলে মনে করা হয়। তাকে আলোচনার টেবিলে আনা অতটা সহজ হবে না বলে মনে করা হচ্ছে।-বিবিসি