আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই : প্রধানমন্ত্রী

শুরুতেই রোহিঙ্গাদের দুর্দশা তুলে ধরলেন। জানালেন জাতিসংঘের এ বৈঠকে আসার আগে তিনি দেখা করে এসেছেন তাঁদের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘এদের দুঃখ-দুর্দশা আমি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি।’ কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর তাঁকেও ছয় বছর কাটাতে হয় ‘উদ্বাস্তু জীবন।’

তুলে ধরেছেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া গণহত্যার কথা।

রোহিঙ্গারা যেন আবার নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানালেন একাধিকবার। সবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি চাই, মানব ধ্বংস নয় মানবকল্যাণ চাই । এটাই হোক আমাদের সকলের লক্ষ্য।’

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়ান তখন বাংলাদেশের ঘড়িতে বাজে ভোর পাঁচ ৪৩ মিনিট।

মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গাদের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন নিজেরও কথা। তিনি বলেন, ‘এদের দুঃখ-দুর্দশা আমি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর আমি আমার ছোট বোনকে নিয়ে ৬ বছর উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো এখানে ভাষণ দেয়ার সময় এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলে গেছেন।’

‘আমরা ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দিচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। এই নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক আভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে গত তিন সপ্তাহে চার লাখ ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া ঠেকানোর জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমানা বরাবর স্থলমাইন পুঁতে রাখছে । এতে আমরা ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এ সব মানুষ যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে।’

মিয়ানমারে‘জাতিগত নিধন’ বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয় ও সংকট নিরসনে পাঁচদফা প্রস্তাব দেন শেখ হাসিনা। মিয়ানমারে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলাসহ কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দাবিও জানান তিনি।

গণহত্যার শিকার বাংলাদেশও

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ভয়াবহতম গণহত্যার শিকার হয় । নয় মাসব্যাপী চলা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে এবং ২ লাখ মা- বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে চিহ্নিত ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে তারা দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গণহত্যার শিকার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সম্প্রতি ২৫শে মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মূলত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে তারা এই গণহত্যার সূচনা করেছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত মূল অভিযুক্তদের আমরা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করেছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বের কোথাও যাতে কখনই আর এ ধরনের জঘন্য অপরাধ সংঘটিত না হয় সেজন্য আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, ৭১-এর গণহত্যাসহ সকল ঐতিহাসিক ট্রাজেডির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের এ লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

‘আমি নিজে বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস জঙ্গিবাদ শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি । একজন সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র নেই। আমি নিজে বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। সে হিসেবে আমি সন্ত্রাসের শিকার মানুষের প্রতি আমার সহানুভূতি প্রকাশ করছি। আমি মনে করি তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।’

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ, এক্ষেত্রে অর্থায়ন বন্ধ, শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিবাদ মীমাংসা করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে আমরা আশাবাদী। জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু সংবেদনশীলতার দিকে লক্ষ্য রেখে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় আমরা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ‘ব্লু ইকনোমি’র সম্ভাবনার প্রতি আমরা আস্থাশীল।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ বন্যা এবং অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য দেখিয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে আমরা শস্য-নিবিড়করণ প্রযুক্তি এবং বন্যা-প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছি। এ বছর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে যে ব্যাপক বন্যা আঘাত হেনেছে আমরা তা সফলভাবে মোকাবিলা করেছি।’