‘আল্লাহর ওয়াসতে আসুন কুরবানির খরচ কমাই বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াই’

খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে পুরো দেশ, ডুবে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চলের গ্রামের পর গ্রাম। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে বানভাসি মানুষের কান্না কষ্ট দুর্ভোগের আহাজারিতে।

জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে চলতি মৌসুমের দ্বিতীয় দফার বন্যায় এ পর্যন্ত ২২ জেলার ৩৩ লাখ ২৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, দিনাজপুর, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজবাড়ী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, যশোর ও রাঙামাটি জেলার ১২২টি উপজেলা ও ৩৮টি পৌরসভা এখন বন্যায় প্লাবিত।

ফারাক্কার বাঁধ নাকি খুলে দিয়েছে প্রতিবেশী ভারত। মমতা দিদি শুষ্ক মৌসুমে মমতাহীনা নারীর মত তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে টাল বাহানা করলেও ”মরার উপর খাঁড়ার ঘা” প্রবাদ বাক্যটি সঠিক প্রমাণিত করে এতোদিন পরে ভরা বর্ষায় বানের পানি বাংলাদেশে প্রবাহিত হওয়ার জন্য তিস্তা নদীর বাঁধও খুলে দিয়েছেন। আমাদের বানভাসি মানুষরা এখন যাবে কোথায় ?

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যাজনিত কারণে গত জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৯২ জনেরই মুত্যু হয়েছে পানির স্রোতে ভেসে।

দুর্গত জেলাগুলোতে কয়েক লাখ হেক্টরের বেশি ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় খাদ্য সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা ।

সংকট এখানেই শেষ, ভাবার কোন কারণ নেই। ইতোমধ্যেই ডায়রিয়া, জ্বর, পায়ের পাতায় ঘা জাতিয় পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত হাজারো মানুষ। খাদ্যের অভাব সুপেয় পানির অভাব, ঘরে বন্যার পানি ঢুকে তছনছ জনজীবন। কিছুদিন আগে ঘর ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু নিয়ে চিরায়ত গৃহস্তের সুখ মাখা যে ছবিটি আমাদের মানস পটে ভেসে উঠত আজ সেখানে কেবলই হাহাকার কেবলই কান্না। বাঁধের উপর কিংবা সামান্য উঁচু কোন জায়গায় নিজের শখের পালিত গরু ছাগল হাঁস মুরগীর সাথে ভাগাভাগি করে কোন রকমে একটু বেঁচে থাকার চেষ্টা করা।

অনেকে তাও পারছেন না, অসহায় ভাবে চোখের সামনে পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে দীর্ঘ দিনের স্বপ্নে লালিত হাঁস মুরগী গবাদি পশু আপনার ভবিষ্যৎ। কখনও বা কোন অভাগা মায়ের আদরের ধন বুকের মাণিক। নির্লিপ্ততায় ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকা ছাড়া আসলে বেশী কিছু করারও নেই তাঁদের। আর কেবল অপেক্ষার প্রহর গুণা, বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার, ওষুধ, সুপেয় পানি, কবে কি করে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে এই পানি বন্দী দুঃসহ জীবন থেকে।

উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হলেও বন্যার পানি ধেয়ে আসছে মধ্যাঞ্চলের দিকে। বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। ইতোমধ্যে যমুনা নদীর কূল ছাপিয়ে উত্তরাঞ্চলকে সংযুক্ত করা টাঙাইলের আলেঙ্গায় পানি জমে যাচ্ছে। কে জানে কখন এই সংযোগ সড়কটিও বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ কালভাট, মানুষের স্বপ্ন আর কল্পনায় ঘেরা বসত বাড়ি।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশন শেষে অর্থমন্ত্রী তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলেছিলেন, ”আমাদের দেশে এখন হত দরিদ্র মানুষ নেই বললেই চলে”। সঙ্গত কারণেই কথাটি সবার মনে গেঁথেছিল। বেশ কয়েক বছর ধরেই মানুষের জীবন মান উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছিল। প্রায় সবার হাতেই এক বা একাধিক মোবাইল ফোন, ঘরে ঘরে টেলিভিশন, ফ্রিজ, ল্যাপটপ পুরো বাংলাদেশের চালচিত্রটাই যেন বদলে যেতে শুরু করেছিল।

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে এবারের বন্যায় সমস্ত হিসেব নিকেশ পাল্টে দিয়ে আবার খানিকটা পিছিয়ে পড়তে হতে পারে। যদিও সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মহল থেকে বার বার বলা হচ্ছে প্রচুর খাদ্য মজুদ আছে, কিন্তু তবুও শঙ্কা রয়েই যায় কেননা বেশ কিছুদিন হল বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্স কমেছে,রপ্তানি আয় কমেছে কিন্তু আমদানির উপর নির্ভরতা বেড়েছে অনেক বেশী। সারা দেশে অবকাঠামো প্রভূত উন্নয়নের জন্য রাস্তা-ঘাট, ব্রিজের গুণগত মান আশানুরূপ না হওয়ায় এই বন্যা কেবল দারিদ্র কৃষক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেই নয় পুরো দেশের অর্থনীতির উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

অল্প কিছুদিন পরেই মুসলমানদের আত্মত্যাগের নিদর্শন স্বরূপ ” পবিত্র ঈদ উল আযহা”। পার্শ্ববর্তী দেশে গরু নিয়ে যতই রাজনীতি হোক কিন্তু বাণিজ্যের জন্য তের পয়েন্টে ছাড় দিয়েছে। অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়ে সরবরাহের আধিক্যে গরুর বাজারে অপেক্ষাকৃত কম দামে গরু পাওয়া যেতে পারে। এটা ক্রেতাদের জন্য অবশ্যই সুখবর কিন্তু এতে করেও আমাদের দেশের গরু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থতার সম্মুখীন হবেন কারণ আশানুরূপ দাম পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হতে পারে।

স্বাধীনতার পর পর চুয়াত্তুরের মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ দেখেছি, ৮৮র বন্যায় ঘাস চিবিয়ে মানুষের বেঁচে থাকাও দেখেছি কিন্তু ২০১৭ তে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে, ব্যক্তি পর্যায়ে ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে অনেক । তাই কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে বানভাসী মানুষদের সাহায্যে সবাই যদি একটু এগিয়ে আসে তাহলেই মোকাবেলা করা সম্ভব। কুরবানি মানে আত্মত্যাগ। কুরবানিতে পশু জবাই করার মাধ্যমে মনের পশুত্বকে বর্জন করা এবং পয়সা খরচ করে স্বার্থ ত্যাগ করে অন্যদের মাঝে বিতরণ করা সামর্থবান প্রতিটি মুমিন মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। অর্থাৎ জানের বদলে জান, সদকা। কিন্তু একজনের জান বাঁচানোটাও তো ফরজ, অতএব আসুন আমরা কুরবানিতে কিছুটা খরচ কমিয়ে অন্তত একটি জান বাঁচানোর চেষ্টা করি। বানভাসি মানুষ গুলোর মুখে খানিকটা খাবার অন্তত তুলে দেই। কুরবানিতে আমরা অনেক দামী গরু উট কিনি। কেউ কেউ অধিক পশু লাখ লাখ টাকায় কিনি । আসুন এবার কুরবানিতে সাশ্রয়ী হই, আর আল্লাহর সৃষ্টি আশরাফুল মখলুকাত মানুষকে এই বিপদে সাহায্য করি।আমরা আল্লাহর ওয়াসতে কুরবানির খরচ কমিয়ে বানভাসি মানুষের পাশে দাড়াই।