ইউটিউব, ফেসবুক কি শক্তের ভক্ত?

সরাসরি সম্প্রচারের যুগে বিতর্কিত ভিডিওর বিরুদ্ধে ফেসবুক-ইউটিউব এত দিন মুখ বুজে ছিল। জঙ্গি, উগ্রবাদ, সহিংসতার ভিডিও নিয়ে অনেকে সমালোচনা করলেও তা গায়ে মাখেনি ইন্টারনেটের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। সম্প্রতি ইউরোপজুড়ে বেড়ে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার মুখে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ফেসবুক-গুগলকে চাপ দিতে শুরু করেছে ইউরোপের দেশগুলো। সম্প্রতি নিজেদের অবস্থান বদলে নীতিমালা পরিবর্তনের কথা বলেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাঁরা কি তবে শক্তের ভক্ত?

বর্তমানে ইন্টারনেট দুনিয়ার জনপ্রিয় তিনটি মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার আর ইউটিউব। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গেছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানো, জঙ্গিদের উৎসাহ-নিয়োগ অনলাইনে হচ্ছে। কিন্তু এ তিনটি মাধ্যমের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা কি দেখা গেছে এত দিন?

ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও কিছুদিন আগ পর্যন্ত এ তিনটি মাধ্যম তাঁদের অবস্থানে অনড় ছিল। বিতর্কিত কনটেন্টের কারণে সহিংসতা বাড়লেও নীতিমালা বদল করেনি ইউটিউব। ২০১২ বিতর্কিত চলচ্চিত্র ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’-এর ভিডিও ক্লিপটি সরানোর অনেক অনুরোধেও সাড়া দেয়নি গুগল। সম্প্রতি গুগল, ফেসবুক ও টুইটার তাদের অবস্থান বদলেছে। বলতে গেলে একরকম অবস্থান বদলাতে বাধ্য হয়েছে। কারণ হচ্ছে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের সরকারের অব্যাহত চাপ। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ফেসবুক ও ইউটিউবকে জঙ্গিবাদ ও অনৈতিক ভিডিওর জন্য কঠোর আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

ফেসবুক লাইভে খুনের ঘটনা, নির্যাতনের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার বেড়েছে। দ্রুত তা ভাইরাল হচ্ছে বা ছড়িয়ে পড়ছে। হাজার হাজার মানুষ দেখছে। বিতর্কিত ভিডিও, ধর্ষণ কিংবা আঘাতের ভিডিও বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের ওই মাধ্যমগুলোকে অনলাইন ভিডিও নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন আইন ও জরিমানার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এত দিন এই ভিডিওগুলো নিয়ন্ত্রণে ‘গড়িমসি’ ছিল তাদের। গত মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মন্ত্রীরা ইউরোপীয় কমিশনের প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছেন। প্রস্তাবিত আইনের কারণেই একপ্রকার বাধ্য হতে হচ্ছে ফেসবুক-ইউটিউবকে। জরিমানার ভয়ে বিদ্বেষমূলক পোস্ট ও যৌনতাবিষয়ক ভিডিও সরাতে হচ্ছে। অবশ্য ওই প্রস্তাবকে আইন হিসেবে পাস করাতে হলে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগবে।

ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আন্দ্রাস আনসিপ বলেন, ‘ভিডিও দেখার নতুন পদ্ধতি আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। উদ্ভাবনী সেবাকে উৎসাহ দিতে সঠিক ভারসাম্যের বিষয়টি খুঁজতে হবে, ইউরোপীয় ছবি প্রচার করতে হবে, শিশুদের সুরক্ষা দিতে হবে আর উন্নত উপায়ে বিদ্বেষমূলক পোস্ট ঠেকাতে হবে।’

ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে ভুয়া খবর ও কনটেন্টের কারণে ফেসবুকের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন নির্বাচনের সময় ভুয়া খবর ছড়ানোয় ফেসবুকের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে। ফেসবুকের পাশাপাশি ইউটিউব ও টুইটারের সমালোচনাও হচ্ছে। এসব মাধ্যম থেকে দ্রুত বিতর্কিত কনটেন্ট সরানোর চাপ বাড়ছে। অবশ্য অনেকেই বলছেন, অতিরিক্ত চাপে বা বেশি বেশি কনটেন্ট সরানোর ফলে বাক্‌স্বাধীনতা থাকবে না।

গত বছর থেকেই লাইভ ভিডিও নিয়ে ফেসবুক সমালোচনার মুখে পড়েছে। গত এপ্রিল মাসে ফেসবুক লাইভে থাইল্যান্ডের এক ব্যক্তি তাঁর ১১ মাস বয়সী মেয়েকে হত্যার দৃশ্য ফেসবুকে দেখান। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ডে ৭৪ বছরের বৃদ্ধকে হত্যা কিংবা শিকাগোতে ১৫ বছরের কিশোরীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা লাইভে চলে আসে। এসব ভিডিও দ্রুত সরিয়ে ফেলতে ব্যর্থ হয় ফেসবুক। বিশেষ করে শিশু সন্তানকে হত্যার ওই ভিডিওটি ২৪ ঘণ্টার বেশি ফেসবুকে ছিল।

সম্প্রতি গার্ডিয়ান প্রকাশিত ফেসবুকের সংশোধন নীতিমালায় দেখা যায়, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ অনলাইন উগ্রবাদের বিভিন্ন ধরনকে ভাগ করতে এবং তা নিয়ে কী করা হবে, সে সিদ্ধান্ত নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

ফেসবুকের মতো দশা ইউটিউবের ক্ষেত্রেও। ইউটিউব থেকে বিতর্কিত ও প্রতারণামূলক ভিডিও না সরানোতে অনেক বিজ্ঞাপনদাতা মুখ সরিয়ে নিয়েছে। যথেষ্ট সেন্সরশিপ না বসানোয় অনেকে ইউটিউবের সমালোচনা করেছেন। ফেসবুক নীতিমালায় পরিবর্তন না আনা পর্যন্ত বিজ্ঞাপনদাতারা জোটবদ্ধ হয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গুগল ক্ষমা চেয়ে নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন আনার কথা জানায়। এ ছাড়া কর্মী নিয়োগ দিয়ে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিতর্কিত কনটেন্ট সরানোর কথা বলেছে গুগল।

মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটারের বিরুদ্ধেও ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। সন্ত্রাসীদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা নিয়ে টুইটার গড়িমসি দেখিয়েছে। তবে গত বছর থেকে টুইটার এ বিষয়ে কিছুটা সক্রিয় হয়। আগ্রাসী অ্যাকাউন্টগুলো শনাক্তকরণে প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহারকারীদের অভিযোগের ওপর নির্ভর করলেও পরে প্রতিষ্ঠানটি তাদের অভিযোগ যাচাইয়ের দল বড় করেছে। সন্ত্রাসী কার্যক্রমের প্রচারণা বা হুমকি দেওয়ার অভিযোগে বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট বাতিল করেছে টুইটার।

তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনার কথা বলেছে ফেসবুক। জঙ্গিবাদের সমর্থন, সহিংস বা আপত্তিকর কোনো পোস্ট বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে ফেসবুকের কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাসী হামলার পরপরই ফেসবুকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কোনো চিহ্ন রাখা হবে না বলে জানিয়ে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। ফেসবুকের সাম্প্রতিক এক ব্লগ পোস্টে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত পোস্টগুলো খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটটির কর্তৃপক্ষ। এ জন্য আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

ফেসবুকের কর্মকর্তারা ব্লগ পোস্টে বলেছেন, ফেসবুকে সন্ত্রাসীদের কোনো কনটেন্ট থাকলে তা খুঁজে বের করে সরিয়ে ফেলতে পর্যালোচনাকারী কর্মীর পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করা হবে। সন্ত্রাসীদের কোনো পোস্ট যাতে অন্যরা দেখতে না পারে, সে জন্য দ্রুত এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে শিশু পর্নো ঠেকাতে এ ধরনের প্রযুক্তি ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে ব্যবহার করা হয়েছে।

চলতি মাসের শুরুতেই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে অনলাইনে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক চুক্তির আহ্বান জানান। প্রস্তাবিত কিছু পদক্ষেপে বলা হচ্ছে, ফলে অনলাইনভিত্তিক কোম্পানিগুলো তাঁদের সাইটে পোস্টের জন্য আইনত দায়ী থাকবে।

ফেসবুকের পোস্টে বৈশ্বিক নীতিমালা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিকা বিকার্ট ও কাউন্টার টেররিজম নীতিমালা ব্যবস্থাপক ব্রায়ান ফিশম্যান থেরেসা মের পোস্টে স্বীকার করা হয়েছে, সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পরে অনলাইনে সন্ত্রাসবাদ দমনে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
পোস্টে ফেসবুকের ওই দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, ফেসবুকের ভূমিকা নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, তার উত্তর দিতে চান তাঁরা। সন্ত্রাসীদের সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে কোনো জায়গা নেই বলে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত তাঁরা।

ফেসবুক ১৫০ জন কর্মী সন্ত্রাসবিরোধী কাজের জন্য মূল দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্যে কাউন্টার টেররিজম বিশেষজ্ঞ, সাবেক আইনজীবী, সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা, বিশ্লেষক ও প্রকৌশলী রয়েছেন।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের সহিংস কোনো ভিডিও কিংবা জঙ্গি কার্যক্রমে উৎসাহ দেয় এমন ভিডিওর বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে ইউটিউব। এ ধরনের কোনো পোস্ট শনাক্ত করে তা মুছে ফেলতে বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে গুগলের ভিডিও সেবা ইউটিউব। এ ছাড়া সন্ত্রাসবিরোধী গ্রুপের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজের আগ্রহ দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ব্লগ পোস্টে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসে উৎসাহ দেওয়া কোনো ভিডিও বা ধর্মীর অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ভিডিওর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে গুগল। নীতিমালা মেনে এ ধরনের ভিডিও তৈরি করা হলেও তাতে সতর্কবার্তার পাশাপাশি অর্থ আয়ের কোনো সুযোগ থাকবে না বা এ ধরনের ভিডিও দেখার জন্য কাউকে সুপারিশ করা হবে না। সহিংস ও জঙ্গি উসকানিমূলক পোস্ট শনাক্ত করতে আরও বেশি প্রকৌশলী ও প্রযুক্তির সমন্বয় করবে গুগল।

গুগলের কর্মকর্তা কেন্ট ওয়াকার বলেন, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে অনেক দিন ধরেই নীতিমালা ভঙ্গকারী পোস্ট শনাক্ত ও মুছে ফেলতে কাজ করা হচ্ছে—তবে এখন বুঝতে পারছি আরও কাজ করতে হবে।

ফেসবুক-ইউটিউব কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া নীতিমালা পরিবর্তনের তড়িঘড়ি উদ্যোগ দেখে ব্যবহারকারীরা নিশ্চয় শক্তের মুখে পড়ার বিষয়টি আঁচ করতে পারছেন!

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, গার্ডিয়ান, ওয়াশিংটন পোস্ট।