ইউরোপ থেকে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে বাড়ছে চাপ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যভুক্ত বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিতে চাপ ক্রমেই বাড়ছে ব্রাসেলস থেকে। নিজ দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে না নিলে ভিসা প্রক্রিয়ায় কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্তও রয়েছে ইইউ’র। আর এরই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নিজ দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারই প্রেক্ষাপটে অবৈধদের ফিরিয়ে আনতে প্রক্রিয়া বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) চূড়ান্ত করতে ঢাকা আসছে ইইউ প্রতিনিধি দল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, অবৈধ হয়ে পড়া ৯৩ হাজার বাংলাদেশিকে ফেরতের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে ইইউর একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে। আগামী মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় পৌঁছাবে। থাকবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। ইইউ প্রতিনিধি দলের সফরে মূলত ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধ বা অনিয়মিত হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ফেরানো সংক্রান্ত ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস’ (এসওপি) চূড়ান্তকরণের আলোচনা হবে। ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সচিবের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাই (ভেরিফিকেশন) সঙ্গে যুক্ত সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তাদের বৈঠক হতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইউরোপ অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরাতে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত। এ সংক্রান্ত এসওপি’র খসড়ায় ‘অবৈধ’ বাংলাদেশিদের ফেরাতে তাদের নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাইয়ে যৌক্তিক সময় প্রস্তাব করেছে ঢাকা। অন্য দেশের কেউ যেন বাংলাদেশে না ফিরে বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকার সতর্ক। এটি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত যাছাই বাছাইয়ে যে সময় লাগবে সেটাই চায় ঢাকা।

গত জুলাইয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইইউ সদস্যভুক্ত বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাপতিত্ত্বে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা অংশগ্রহণ করে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ইইউতে থাকা এসব অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা হবে। এদের ফিরিয়ে আনতে ইইউ একটি প্রক্রিয়া বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) প্রস্তাব করেছিল। সেই সঙ্গে চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে এসওপিটি চূড়ান্ত করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল ইইউ। এসওপিটি বাংলাদেশ চূড়ান্ত করেছে। আর এটি ইইউ’র কাছে পাঠিয়েও দেয়া হয়েছে।

এতে চার ধাপে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে এসব বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনো সময়সীমা চায় না বাংলাদেশ। নিয়মমাফিক উপায়ে এসব অবৈধ বাংলাদেশিদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে ফিরিয়ে আনা হবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। ইইউকে বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, এসব বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে কোনো সময়সীমা চাইছে না। এ বিষয়ে ইইউকে নমনীয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা। তবে যত দ্রুত সম্ভব চার ধাপে এসব বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা হবে। প্রথমত যারা বন্দি অবস্থায় রয়েছে তাদের এক প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করা হবে। ইইউ’র সদস্যভুক্ত দেশে আটককৃতদের সাক্ষাৎকার নিবে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস। যত দ্রুত সম্ভব তা করার চেষ্টা করবে।

দ্বিতীয়ত যাদের কাছে পাসপোর্ট রয়েছে ভিসাও ছিল কিন্তু তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তাদের যাচাই-বাছাই হবে এক রকমভাবে। তৃতীয়ত যাদের শুধু বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে কিন্তু ভিসা নেই এবং অন্য কোনো কাগজ-পত্র নেই তাদের যাচাই-বাছাই এক রকমভাবে হবে। যাদের যার কিছুই নাই তাদের যাচাই-বাছাই এক রকমভবে সম্পন্ন করা হবে।

এর আগে চলতি মাসে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইইউ হেডকোয়ার্টারে হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ-ইইউ যৌথ কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় হয়েছে। চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে অভিবাসী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বা স্ট্যার্ন্ডাড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) চূড়ান্ত করার জন্য বাংলাদেশকে সময় বেঁধে দিয়েছিল ইইউ। ২০১৬ সালের দেয়া এসওপি নিয়ে অগ্রগতি এতই সামান্য হয়েছে যে এতে বিরক্তি প্রকাশ করেছে ইইউ।

জানা গেছে, যৌথ কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ ও ইইউ’র মধ্যে অভিবাসন নিয়ে গভীর আলোচনা হয়েছে। অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া নিয়ে একটি সংশোধিত খসড়া এসওপি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল বৈঠকে উপস্থাপন করে। এসব অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী ফিরিয়ে আসতে ২০১৬ সালের জুন মাসে ইইউ এসওপিটি ঢাকাকে দিয়েছিল। এর অগ্রগতি এতই সামান্য হয়েছে যে নির্ধারিত সময়ে মধ্যে আলোচনা করে এ এসওপি নিয়ে কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো যাবে না।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যানভিত্তিক অধিদফতর ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে অনুপ্রবেশ করা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ৩০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। সংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭তম।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত ২৮টি দেশে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশ করেছে। ২০০৮ সালে ৭ হাজার ৮৫ জন, ২০০৯ সালে ৮ হাজার ৮৭০ জন, ২০১০ সালে ৯ হাজার ৭৭৫ জন, ২০১১ সালে ১১ হাজার ২৬০ জন, ২০১২ সালে ১৫ হাজার ৩৬০ জন, ২০১৩ সালে ৯ হাজার ৪৯০ জন, ২০১৪ সালে ১০ হাজার ১৩৫ জন এবং ২০১৫ সালে ২১ হাজার ৪৬০ জন বাংলাদেশি ইইউ সদস্যভুক্ত ২৮টি দেশে অবস্থান করছে।

এরা বিভিন্ন সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আটক হয়েছে। এছাড়া তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান দ্বিতীয়, পাকিস্তান ষষ্ঠ এবং ভারত ৯ম স্থানে রয়েছে। আফগানিস্তানের ৭ লাখ ১ হাজার ১১৫ জন, পাকিস্তানের ২ লাখ ৩৯ হাজার ৮৫০ জন এবং ভারতের ১ লাখ ৩২ হাজার ৭১০ জন ইউরোপে অবৈধ অনুপ্রবেশ করেছে।