উচ্চহারে ভ্যাট-কর : ক্ষোভে ফুঁসছে সাধারণ মানুষ

সাধারণ মানুষের পকেট থেকে অর্থ কেড়ে নেয়ার আয়োজন চূড়ান্ত। ব্যাংক লেনদেনে নতুন করে আরোপিত আবগারি শুল্কের নামে এ অর্থ কেড়ে নেয়া হবে। বৃহস্পতিবার উপস্থাপিত বাজেটে এ ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেট বক্তৃতায় এ ঘোষণা দেয়ার পর ক্ষোভে ফুঁসছে সাধারণ গ্রাহক। তারা বলছেন, এটা জালিয়াতি, প্রয়োজনে ব্যাংক লেনদেন বন্ধ করে দেব।

বরিশালের এক গ্রাহক বলেছেন, আবগারি শুল্ক যে কতটা ভয়ঙ্কর তা আমি বুঝেছি স্থায়ী আমানত করতে গিয়ে।

বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা গ্রাহকদের এই ক্ষোভের সঙ্গে একমত। তারা বলছেন, এ ধরনের কাজ রাষ্ট্র করতে পারে না। এটা রীতিমতো অন্যায়, অবিচার এবং গ্রাহকদের শাস্তি দেয়ার শামিল।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, অর্থমন্ত্রী যেভাবে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা নিচ্ছেন, এটা অনৈতিক; এ ধরনের কাজ রাষ্ট্র করতে পারে না। অনেকে রাজস্ব দেয়ার পর নগদ টাকা হাতে রাখেন। সে টাকার ওপর কর হয় না। কিন্তু টাকাটা ব্যাংকে রাখলেই কেন কর দিতে হবে। এটা আমানতকারীদের এক প্রকার শাস্তি দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক লেনদেনে মুনাফায় উৎসে কর কাটা হয়। তার ওপর আবগারি শুল্ক দেড়গুণ করা ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে গণমানুষকে ব্যাংকের আওতায় আনার লক্ষ্য ব্যাহত হবে। মানুষের কষ্ট বাড়বে। মানুষও কিছুটা ব্যাংকবিমুখ হতে পারে।

সূত্র জানায়, কারও ব্যাংক হিসাবে এক লাখ এক টাকা থাকলে বছর শেষে মুনাফা হতে পারে প্রায় তিন হাজার টাকা। এর মধ্যে মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ উৎসে কর কাটা হবে প্রায় ৪৫০ টাকা। এরপর ৫০০ টাকা কাটা হবে হিসাব পরিচালনার খরচ বাবদ। সঙ্গে এটিএম ব্যবহারের খরচ রাখা হবে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। প্রস্তাবিত নীতি অনুযায়ী ‘আবগারি শুল্ক’ নামে কাটা হবে আরও ৮০০ টাকা। সারা বছরে একজন গ্রাহকের তিন হাজার টাকা মুনাফার ওপর কেটে নেয়া হবে দুই হাজার ২৫০ টাকা। এতে তার থাকবে মাত্র ৭৫০ টাকা। এভাবে গ্রাহকের অধিকাংশ অর্থ যাবে সরকারের পকেটে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এ তসলিম বলেন, এ নীতি কার্যকর হলে ব্যাংকিং খাতকে নিরুৎসাহিত করা হবে। তা ছাড়া যত্রতত্র আয়কর বসালে এমনই হয়।

তিনি বলেন, সব ধরনের ব্যাংক লেনদেনে উল্লিখিত নীতি প্রযোজ্য হলে, এটি হবে সবচেয়ে ভয়াবহ। এতে অর্থপাচার বেড়ে যেতে পারে। তার মতে, অর্থপাচারে উদ্বুদ্ধ হবে বড় গ্রাহকরা। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোটরা।

বেসরকারি ব্যাংকের গ্রাহক রেজওয়ানুল ইসলাম জানান, এটা বড় ধরনের জালিয়াতি। কিছুতেই এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া হবে না। প্রয়োজনে ব্যাংকে লেনদেন বন্ধ করে দেব।

অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে বলেছেন, বছরের যেকোনো সময় ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা জমা দিলে বা তুললে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কেটে রাখা হবে। আগে রাখা হতো ৫০০ টাকা। একইভাবে, ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত কোনো হিসাবে জমা দিলে বা তুললে দুই হাজার ৫০০ টাকা কেটে রাখা হবে। আগে কেটে রাখা হতো এক হাজার ৫০০ টাকা। এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা হিসাবে থাকলে ১২ হাজার টাকা কেটে রাখা হবে। এসব হিসাব থেকে আগে কেটে রাখা হতো সাত হাজার ৫০০ টাকা। পাঁচ কোটি টাকার বেশির ক্ষেত্রে কেটে রাখা হবে ২৫ হাজার টাকা, যা আগে ছিল ১৫ হাজার টাকা।

অর্থমন্ত্রী বলেন, সবক্ষেত্রে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কারণে ব্যাংকিং লেনদেনের আকার দিন দিন বাড়ছে। এ বিবেচনায় এবং রাজস্ব আহরণের স্বার্থেই নতুন প্রস্তাব করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এক লাখ থেকে ৫০ কোটি টাকার বেশি লেনদেহ হয় এমন হিসাব রয়েছে প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ ৬১ হাজার ৩৫৫টি।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে আমানতে সুদের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩ থেকে ৫ শতাংশ। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস চার্জ। এ ছাড়া মুনাফার ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। হিসাব স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর ফলে আমানতকারীরা ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়বেন। এর বদলে ছুটবেন তারা শেয়ারবাজার বা সমবায় সমিতিগুলোতে।

এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, পৃথিবীর কোথাও ব্যাংক হিসাব থেকে এত টাকা কেটে রাখা হয় না। আবগারি শুল্কের ওপর প্রস্তাবিত নীতি কার্যকর হলে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবেন।

এ প্রসঙ্গে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুর রহমান বলেন, ব্যাংক লেনদেনে আবগারি শুল্ক বাড়ানো ঠিক হয়নি। এর মাধ্যমে আমানতকারীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বরং উৎসাহিত করা হচ্ছে অর্থপাচার এবং অনুৎপাদনশীল খাতকে। অর্থাৎ জমি-জায়গা কিনবে। নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দিকে ছুটবে মানুষ। এ ছাড়া বড় ও অসৎ ব্যবসায়ীরা আরও বেশি অর্থপাচারে ঝুঁকবে বলে মনে করেন তিনি।

মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, নতুন করে আবগারি শুল্ক বাড়ালে মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে বাড়িতে রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। এর মাধ্যমে ব্যাংকের আমানতপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন বেড়ে গিয়ে সামাজিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি হবে।

বিডিবিএলের এমডি মনজুর আহমেদ বলেন, ব্যাংকবিমুখ হতে পারে গ্রাহক। ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরফান আলী যুগান্তরকে বলেন, আবগারি শুল্কের নতুন নীতি কার্যকর হলে আমানতকারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক বিমুখ হবে গ্রাহক। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে যাবে অর্থ।

তিনি বলেন, মুখে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির কথা বলা হলেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে।

‘আবগারি শুল্ক যে কতটা ভয়ঙ্কর তা আমি বুঝেছি’

বরিশাল ব্যুরো জানায়, এদিকে আবগারি শুল্ক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বরিশালের ব্যবসায়ীরা। বরিশাল নগরীর কাউনিয়া এলাকার বাসিন্দা আল আমিন পাইক বলেন, ‘আবগারি শুল্ক যে কতটা ভয়ঙ্কর তা আমি বুঝেছি স্থায়ী আমানত করতে গিয়ে। চলতি বছরের গোড়ার দিকে ব্যাংকে দুই লাখ টাকার একটি এক বছর মেয়াদি এফডিআর করি। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় জরুরি ভিত্তিতে সেই টাকা তুলতে গেলে ব্যাংক আমাকে ফেরত দেয় এক লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা।

জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, আবগারি শুল্ক বাবদ ৫০০ টাকা কেটে নেয়া হয়েছে। আমার টাকা আমি ব্যাংকে জমা দিলাম। কোনো লাভ বা সুদও পেলাম না। অথচ সরকার আমার বহু কষ্টে জমানো টাকা থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে গেল। এটা কেমন আইন?’

একটি প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি ব্যাংকের একজন ম্যানেজার বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘এটা সরকারি বিধান। ব্যাংকে টাকা রাখলে আবগারি শুল্ক দিতে হবে। তাতে সুদ জমা হোক আর না হোক। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার নেই।’ (প্রতিবেদন দৈনিক যুগান্তরের সৌজন্যে প্রকাশিত)