একজন ফাতিমার ৩০ বছর অন্ধকারে কাটানোর গল্প

এ এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। ৫২ বছর বয়সী ফাতিমা জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন গোপন এক আশ্রয় কেন্দ্রে। না, ধর্ষণের শিকার হয়ে কিংবা নিজে কোনো অপরাধ করার কারণে এই শাস্তি পাচ্ছেন না তিনি।

স্বেচ্ছায় অন্তরালে যাওয়া কিংবা পরিবার তাকে হন্যে হয়ে খোঁজার ঘটনাও ঘটেনি। বরং পরিবার তাকে সম্মান রক্ষার জন্য ৩০ বছর আগে বাড়িছাড়া করে কারাগারে পাঠানোর পথ করে দিয়েছে। কেবল জোর-জবরদস্তি করেনি; মেরে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছিল।

ঘটনাটি ঘটেছে জর্দানের রাজধানী আম্মানে। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে ফাতিমার বোন গর্ভবতী হওয়ার পর তাদের বাবা ধারণা করেন, তাতে ফাতিমারও দোষ রয়েছে। পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য সেসময়ই তাদের দু’বোনকে গুলি করেন তাদের বাবা।

ফাতিমা জানান, বোনকে ওই সময়ই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আর যখন আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়, সেসময় আমাদের প্রতিবেশীদের কেউ পুলিশে খবর দেয়। তারপর আহত অবস্থায় পুলিশ আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করালে সেখানেই ছয় থেকে সাত মাস চিকিৎসাধীন ছিলাম। পরে পুলিশ আমাকে সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে কারাগারে রাখে।

তার পর কারাগারে ২২ বছর অতিবাহিত করার পর এখন আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি। দেশটির একটি আইনে বলা আছে, কোনো নারীকে পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য হত্যার আশঙ্কা থাকলে তাকে অনির্দিষ্ট সময় ধরে কারাগারে রাখা যাবে। সেই আইনে কারাগারে ২২ বছর কাটিয়ে এখন আশ্রয়কেন্দ্রে দিন পার করছেন ফাতিমা। সেই আশ্রয়কেন্দ্র একটি দাতব্য সংস্থার বলে জানিয়েছেন তিনি।

নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সিস্টারহুড ইজ গ্লোবাল ইনস্টিটিউট (এসআইজিআই) এর মতে, দেশটির এক হাজার সাতশ নারী কারাবন্দির মধ্যে ৬৫ শতাংশ নারী ৬০ বছরের পুরনো সেই আইনের ফলে পঁচে মরছে।

দেশটিতে অনারকিলিংয়ের সরকারি কোনো হিসাব নেই। তবে মানবাধিকারকর্মীদের দাবি ২০১৬ সালে অন্তত ৪২ জন নারী তাদের স্বজনের হাতে খুন হয়েছেন।

সারাবিশ্বে অনারকিলিংয়ের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে জর্দান অন্যতম। নারীরা সেখানে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে; প্রতিনিয়ত খর্ব হচ্ছে নারী অধিকার। তবে সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কোনো ধর্ষণকারী আর বিয়ে করে অপরাধ এড়াতে পারবে না।

উদ্বেগ উৎকণ্ঠা

চলতি বছরের মার্চে আদালত অনারকিলিংয়ের আইন সংশোধন করে। সেখানে উল্লেখ করা হয় এখন থেকে আর কেউ পারিবারিক সম্মানের কারণে নারীদের ওপর কোনো জুলুম করতে পারবে না।

মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে সরকারের সমন্বয়ক বাসেল তারানেহ বলেন, পরিবর্তনের জন্য আমরা সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি; এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের ব্যাপারেও আলোচনা চলছে। তবে ইতিবাচক ফলাফলের জন্য আরও দীর্ঘসময় কাজ করতে হবে বলেও জানান তিনি।

কিন্তু নারী অধিকারকর্মীরা এ ধরনের অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি সেই পরম্পরা বন্ধেরও দাবি জানিয়ে আসছেন। পরিবারের কাছ থেকে যাতে নারীরা ঝুঁকির বদলে নিরাপত্তা পায় সে ব্যবস্থা করারও আহ্বান জানান তারা।

তাদের যুক্তি, যে সকল নারীদের জীবন হুমকির সম্মুখীন, রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পেরে তাদেরকেই অন্যায়ভাবে আটকে রাখছে। এতে করে ওই নারীদের অধিকার খর্ব হচ্ছে।

জর্দানের জাতীয় নারী অধিকার কমিশনের সাধারণ সম্পাদক সালমা নিমস বলেন, আমরা তাদের রক্ষার জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে পারিনি। তাছাড়া সামাজিকভাবে বিষয়টি নিয়ে প্রচলিত ধারণাও বদলাতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা।

তিনি আরও বলেন, সেকারণে আমাদের উচিত হবে সরকারিভাবে নারী নিপীড়নের সেই আইন বাতিল করা। সেই সঙ্গে নারীদের সুরক্ষার ব্যাপারেও আমাদের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

অযুহাত কেবল নিরাপত্তা শঙ্কা

নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, অনেক নারী তাদের স্বজনদের সহিংসতার শিকার হয়ে কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটান।

ড্যানিশ ইনস্টিটিউট এগেইনেস্ট টরচারের ২০১৪ সালের এক পরিসংখ্যানে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে, কীভাবে সেখানকার নারীরা পরিবারের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়। রেহাব নামের ৩২ বছর বয়সী এক নারী তালাকের শিকার হওয়ার পর সাত মাস ধরে কারাগারে বন্দি রয়েছেন। কারণ তাদের পরিবার মনে করছে, তালাকের কারণে তাদের সম্মানহানি হয়েছে।

কারাগারে বন্দি থাকা এইসব নারীদের কাছে আরও যন্ত্রণার হয়ে ওঠে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার হওয়া নারীদের সঙ্গে থাকতে গিয়ে। কারণ এই সব নারীদের জন্য আলাদা কোনো স্থান না থাকায় অপরাধী নারীদের সঙ্গে একই কারাগারে অপরাধীর মতো করেই রাখা হয়।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক আদম কুগলি বলেন, একজন নারীর নিজেরই নিরাপত্তার দরকার। অথচ তাকে রাখা হচ্ছে খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত কিংবা অন্য কোনো অপরাধী নারীর সঙ্গে। এতে করে তাদের নানা ধরনের মানসিক সমস্যা হতে পারে।

সেরকম তথ্যই দিচ্ছেন ফাতিমা। ২২ বছর কারাগারে কাটানোর সময় নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে গেছেন তিনি। এতে করে তার মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়েছে। অনেক কিছুই স্বাভাবিকভাবে কল্পনাও করতে পারেন না তিনি।

সেখানে আরেকটি ব্যাপার রয়েছে, কোনো নারীকে কারাগার থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাদের পরিবারের কোনো পুরুষের স্বাক্ষরের প্রয়োজন হয়। ওই নারীর নিরাপত্তার যাবতীয় দায়ভার তিনি গ্রহণ করলেই কেবল ওই নারীকে ছেড়ে দেয়া হয়।

তবে, নারী অধিকারকর্মীদের বক্তব্য অনুযায়ী, নানা সময় দেখা গেছে পরিবারের কেউ একজন ওই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে স্বাক্ষর করে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পর নানা ধরনের নির্যাতন এমনকি হত্যাও করেছেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে কোনো রকম বিচার হয়নি।

সেকারণে তাদেরকে কারাগার থেকে ছাড়া হলেও আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়। দেশটির দাবি, নারীদের নিরাপত্তার জন্যই এমনটি করা হয়ে থাকে।

তারপরেও মুক্তি কি মেলে?

দেশটির একজন বিচারক ইভা আবু হালাওয়ে বলেন, পরিবার কখনো চয় না তাদের মেয়ে খুন হোক; তাদের মা-বাবারও অনুভূতি রয়েছে; কারণ দিন শেষে তো ওই নারীরা তাদেরই মেয়ে।

এই নারীদের মুক্তি মেলে কেবল বিয়ের মাধ্যমে। তাদের স্বাধীনতার একমাত্র পথ বিয়ে। কিন্তু কারাগারে থাকা অবস্থায় স্বামী পাওয়া আরেক মুশকিল। আবার অনেকেই অযোগ্য কোনো ব্যক্তিকে বিয়ে করতে পারেন মুক্তির আশায়।

ইভা বলেন, সেই লোককে বিয়ে করেও নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। তাদের ছাড়ানোর এটা একটা প্রশাসনিক প্রক্রিয়া মাত্র।

তিনি আরও বলেন, ওই নারীর জন্য হয়তো এটা সবচেয়ে ভাল উপায়। এতে করে তিনি হয়তো কারাগারে আটক থাকা থেকে মুক্তি পান।

২৬ বছর বয়সী স্বসান (ছদ্মনাম, প্রকৃত নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তিনি) দুই বছর ধরে কারাবন্দি ছিলেন। বাবার আক্রমণের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, এক লোক আমার কাছে এসে বলেছে সে আমাকে বিয়ে করে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে চায়। তার কয়েকদিন পর সরকারিভাবে আমাকে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে কিছু কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে বিয়ে হওয়ার কথা জানানো হয়।

চার বছর আগে তাকে কারাগার থেকে নিয়ে এসে এখন দুটি বাচ্চাও রয়েছে তার। এখন তার দেখভালও করেন না সেই মাদকাসক্ত স্বামী। সন্তানদের নিয়ে এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।

তিনি আরও জানান, এখন তো আমার কাছে ভিন্ন কোনো উপায়ও নেই। যদি আমি তাকে তালাক দিই, আমার যাওয়ার মতো কোনো পথও নেই। হয় আমাকে কারাগারে যেতে হবে না হয় রাস্তায় নামতে হবে।

এইসব নারীদের নিরাপত্তার জন্য ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে একক একটি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করার সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সেই ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। অবশ্য সেই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

নিয়ামস বলছেন, এটা কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে সমাধান হওয়ার মতো সংকট নয়। এজন্য পুরো সিস্টেমটাকে বদলাতে হবে; আইন পরিবর্তন করতে হবে; সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে; তাদের সুরক্ষা আইনিভাবে নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের রক্ষার দায়িত্ব সর্বোপরি রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর