এখনও ঝুঁকিপূর্ণ আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে ভয়াল সাইক্লোন আইলা। ২০০৯ সালের ২৫ মে এ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সবকিছু। বৃহস্পতিবার আইলা’র অষ্টম বর্ষপূর্তি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইলা বিধ্বস্ত উপকূলবাসীর দিন-রাত কাটছে সেই বেড়িবাঁধের ওপর। এখনও নিশ্চিত করা যায়নি তাদের মাথা গোঁজার সামান্য ঠাঁইটুকুও। কয়রার উত্তর বেদকাশী, মহারাজপুর এবং দাকোপের কামারখোলা ও সূতারখালী ইউনিয়নের অনেক মানুষ এখনও বেড়িবাঁধের ওপরে বাস করছেন।

সূত্র মতে, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে। উপকূলের ১১টি জেলায় প্রায় ৬ লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়, ৮ হাজার ৮’শ কিলোমিটার রাস্তাঘাট ভেঙে যায়। খুলনা ও সাতক্ষীরার ৭১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রয় দেড় লাখ একর জমি নোনা পানিতে তলিয়ে যায়।

এর মধ্যে জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদ কয়রা, দাকোপ, শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলার ৪৪টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে ৬ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং অগণিত গবাদিপশু পানিতে ভেসে গিয়ে মারা যায়। জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে ৪১ ব্যক্তি প্রাণ হারায়। শত শত চিংড়ি ঘের ভেসে যায়।

ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানার পর ইতোমধ্যেই বঙ্গোপসাগরে লায়লা, গিরি, হুদহুদ, নিলোফার, নার্গিস ইত্যাদি নামের ১৭টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। মহাসেন ও কোমেন ছাড়া এ অঞ্চলে কোনো ঝড় আঘাত হানেনি। ২০১৩ সালে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন মধ্য উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানলে ১২ জন এবং ২০১৫ সালে ঘূর্ণিঝড় কোমেনের আঘাতে ৪ জনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ গত বছরের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু মধ্য ও পূর্ব উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। এতে ঝরে যায় ২৪টি প্রাণ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ২ লাখ মানুষ। তাতেও অন্তত ৮শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়, নোনা পানিতে প্লাবিত হয় ১ লাখ একর ফসলি জমি। এ ঘূর্ণিঝড় খুলনা-সাতক্ষীরা-বাগেরহাটে আঘাত না হানলেও কমপক্ষে ৬টি স্থানে বেড়িবাঁধে ফাঁটল ধরে। এছাড়া খুলনার ৪ নম্বর কয়রা, মহারাজপুর ও কালাবগীতে জলোচ্ছ্বাসের পানি বেড়িবাঁধ উপচেপড়ার উপক্রম হয়।

এদিকে, শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, আশাশুনির চাকলা, কুড়িকাউনিয়ার বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ আইলা পরবর্তী দু’বছর পর মেরামত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত অংশে মাঝে মাঝে ভেঙে গিয়ে মানুষের সম্পদহানি ঘটছে।

গত বছর আইলা’র সপ্তম বর্ষপূর্তিতে বেসরকারি সংগঠন গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান (সিএসআরএল) ও সদস্য সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে আইলা বিধ্বস্ত অধিবাসী এবং তাদের এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবির মধ্যে ছিল- প্রয়োজনীয় বিধিমালা ও দাপ্তরিক আদেশ জারি করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন কার্যকরকরণ, আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত ও ভূমি হারানো পরিবারগুলোকে খাসজমি বিতরণ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে পুনর্বাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন কার্যকর করার পূর্ব পর্যন্ত বেড়িবাঁধ কাটা ও ছিদ্র করার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি থেকে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা রক্ষায় বেড়িবাঁধগুলো পরিবেশসম্মত ও শক্তিশালীকরণ, উপকূলীয় কৃষি ও জীবনযাত্রা রক্ষায় অপরিকল্পিত নোনাপানির চিংড়ি ঘের বন্ধকরণ এবং উপকূলীয় অঞ্চলে যে কোনো কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘সমন্বিত উপকূলীয় ব্যবস্থাপনা নীতি’ অনুসরণ বাধ্যতামূলক করণ। যদিও এক বছর পেরিয়ে গেলেও এসব দাবি বাস্তবায়ন হয়নি।

কয়রার উত্তর বেদাকাশি ইউপি চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, কাশিরহাট, কাটকাটা, গাতিরঘেরি, হরিহরপুর, গাববুনির ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এখনও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিষয়টি বার বার অবহিত করা হলেও তারা বেড়িবাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেয়নি। জরুরি ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে পর্যাপ্ত মাটি ফেলানো না হলে আগত বর্ষা মৌসুমে আবারও ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বদিউজ্জামান বলেন, আইলা পরবর্তীতে সরকারি বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতায় কয়রার মানুষ বহুলাংশে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। নাজুক বেড়িবাঁধের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে। আগামীতে পাউবো ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো মেরামত করবে বলে আশা করছেন তিনি।