এটাই হবে আমার জীবনের শেষ ছবি : নায়করাজ রাজ্জাক

আসাদুজ্জামান নূরকে জীবনে শেষবারের মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ২৯ জুলাই দেশ টিভির স্টুডিওতে দৃশ্যায়ন হয় ‘বেলা অবেলা সারাবেলা’র। দুই পর্বে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয় দেশ টিভিতে—৬ ও ১৩ আগস্ট। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হলো:

১৯৬৭ সালে ‘বেহুলা’ দিয়ে নায়ক হিসেবে আপনার যাত্রা শুরু। ওই সময় আমাদের দেশের রাজনৈতিক পটভূমির খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে শুরু করল। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দিলেন, ছাত্ররা এগারো দফা দিল। সব মিলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গোটা বাংলাদেশ স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর প্রভাব তো চলচ্চিত্রেও পড়েছে?

তখন চলচ্চিত্রে কিছু ব্যক্তি ছিলেন, যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জহির রায়হান সাহেব যুক্ত ছিলেন। আরো অনেকেই ছিলেন। আমরাও মোটামুটি জড়িত ছিলাম। জহির সাহেবের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, যেকোনো কিছু করার আগে বাসায় একটা মিটিং করতেন নিজস্ব কিছু লোকজন নিয়ে। আমি আসতাম। নায়িকা বা অন্য আর্টিস্টরাও থাকতেন, রাইটাররা থাকতেন।
আমজাদ হোসেন সাহেব থাকত। তিনি বললেন, আমি একটা ছবি বানাব। বললাম, আপনি তো ছবি বানাচ্ছেন! বলেন, না, একটু অন্য রকম ছবি বানাব। উনি সাবজেক্টটা বললেন—‘জীবন থেকে নেয়া’। শুনে বললাম, খবরদার আপনি এমনিতেই ওদের নজরে আছেন। মাঝখানে গোষ্ঠীসুদ্ধ আমরা যাব। বললেন, চিন্তা কইরেন না। ধরার ক্ষমতা নেই।

এটা তো সাহসী একটা উদ্যোগ ছিল…

সাহসী মানে কী! তিন নম্বর ফ্লোরে আমি শুটিং করছি। আমার এখনো মনে আছে, হঠাৎ সকাল ১১টার দিকে পুরো তিন নম্বর ফ্লোর পাকিস্তানি আর্মি ঘিরে ফেলল। এক মেজর নামল। জহির রায়হান সাহেব কে? ডাকলাম। হিরো কে? আমি এলাম। চলেন। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেল। জহির রায়হান ভাইয়ের সঙ্গে কী বাহাস, কী তর্ক! বলে, তুমি অ্যান্টি পাকিস্তানি ছবি বানাচ্ছ। জহির ভাই বললেন, আমি কি বানাচ্ছি না বানাচ্ছি, তোমাদের সেন্সর বোর্ড আছে, তুমি সেন্সরে আটকাও। যাহোক, সেই ছবি শেষ করলাম আমরা। পাকিস্তানিরা ততটা বোঝেনি। রওশন জামিল ভাবি যে আইয়ুব খান, অমুক যে অমুক, আমি শেখ মুজিবের ক্যারেক্টার করেছি—কেউ বোঝেনি। তবুও ছবি সেন্সরে আটকাল। আবার ছাড়ল। রিলিজের পর আবার ব্যান্ড হলো। স্টুডেন্ট মুভমেন্ট হলো। ছবিটাকে স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিল বলা যায়।

ছবিটা মানুষ দেখেওছিল…

আরে বাপরে বাপ! তখন এমন কোনো লোক নেই যে ‘জীবন থেকে নেয়া’ দেখেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এটা পশ্চিমবঙ্গে চলেছে। পাড়ায় পাড়ায় চলেছে। একটা প্রিন্ট চিত্তবর্ধন নিয়ে চলে গিয়েছিল। দেখিয়েছে ওটা।

আপনি ২৫শে মার্চ রাতে কোথায় ছিলেন?

বাড়িতেই ছিলাম। আর্মিদের সঙ্গে আমার একটা গণ্ডগোল হয়েছিল [হাসি]। তারপর তো পালিয়ে ছিলাম। জহির ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন গুলশানের বাড়িতে। ওখানে বড়দা মানে শহিদুল্লা কায়সার থাকতেন। উনি চলে গিয়েছিলেন ধানমণ্ডি। আমি উনার রুমে থাকতাম। আমি যাওয়ার পরদিন উনি কলকাতা চলে যাবেন। বললাম আমাকে নেন। বললেন, না, আপনাকে নেওয়া যাবে না। আপনাকে নিয়ে বাংলাদেশ পার হওয়া যাবে না।

ওটা কোন সময়? ২৫শে মার্চ?

২৫শে মার্চের পরে। উনি বললেন, আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। .. ..১৭ দিনের মাথায় ছড়িয়ে গেল, আমি আগরতলায়। আমাকে আবার নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টে। তিনবার নিয়ে গেছে আমাকে।

আর্মি আপনাকে কেন নিয়ে গেল?

বলে, আমি নাকি কলকাতায়। বললাম, আমাকে তো তোমার লোক আমার বাড়ি থেকে আনল। আকাশবাণীতে নিউজ হয়েছে বিখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পী রাজ্জাক আগরতলায় আসছেন। এই তো শুরু। আমাকেও তুলে নিয়ে গেছে।

ওই ৯ মাস কিভাবে সময় কেটেছে?

আমি হাউস অ্যারেস্ট ছিলাম মোটামুটি। আমার ওপর নজরদারি ছিল। আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন। একবার আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড মেরেছিল বনানীতে। দেশে থেকে যতটুকু পারা যায় করেছি। বাড্ডা থেকে তখন গুলশান ঢুকতে খুব সুবিধা হতো মুক্তিযুদ্ধের ছেলেদের। তাদের সঙ্গে আমার একটা লিয়াজোঁ ছিল। কলকাতা থেকে জহির ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতো।

স্বাধীনতার পর যখন জহির ভাই ফিরে এলেন তখন দেখা হয়েছিল আপনাদের?

সেটা এক বিরাট ট্র্যাজেডি। আমি তার বাড়িতে গেলাম। লোকটা তখন পাগল হয়ে আছে বড়দা বড়দা বলে। মানে শহিদুল্লা কায়সার। তাঁকে কোথায় না খুঁজছেন তিনি। গাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে কথা হতো, বাড়িতে কথা হতো। বলে, আমি কী করব? আমি বলি একটু শান্ত হন…যে লোকটা কোনো দিন ধর্মকর্ম মানত না সে আজমির শরিফ যাবে। আমাকে বললেন, আপনিও চলেন, ওপারের লোকেরা আপনাকে খুঁজছে। একবার যে আর্মিরা আমাকে পিটিয়েছিল, সবাই মনে করেছিল আমাকে মেরে ফেলেছে। তো গেলাম কলকাতা। যেতে যেতে অনেক কথা। বললেন, যদি বড়দাকে খুঁজে পাই আমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেব। কলকাতায় উনি ওনার মা, খালাদের নিয়ে আজমির শরিফ চলে গেলেন। আমি কলকাতায় হোটেলে উঠেছি। সেখানে সুচন্দার সঙ্গে দেখা। সে আমাকে বলল, আপনি জহিরকে ঠেকান। লোকটা তো পাগল হয়ে যাবে। জহির ভাই আমার কথায় রাজি হলেন। ঈদ করে আমার সঙ্গে ঢাকায় ফিরবেন। পরে বললেন, না, আম্মারা চলে যেতে চাচ্ছেন আমি তাদের নিয়ে যাই। গেলেন। তিন দিন পর ঈদ। আমি ঈদ করে ফিরলাম। কারফিউর মধ্যে মিরপুর পার হয়ে বাড়ি ফিরেছি। বাড়ি ফেরার পর আমার সেক্রেটারি বললেন, আপনি কেমন করে এলেন স্যার। মিরপুরে তো কারফিউ। বলে, জহির সাহেব মিসিং। আমি দৌড়ে গেলাম। পরে কান্নাকাটি। আর পাওয়া গেল না।

চলচ্চিত্রের কী অবস্থা তখন?

বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। জহির সাহেব নেই। কী হবে ছবির। ইন্ডিয়ান ছবি রিলিজ করার জন্য তখন অনেকে দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। আমরা সবাই গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। ইন্ডাস্ট্রি চলবে কী করে? তাঁকে বোঝালাম। তিনি বললেন, তাহলে ইন্ডিয়ান ছবি আনতে কেন বলছে এরা? আমরা বললাম, একদল স্বার্থপর আছে। বললেন, ঠিক আছে। ছবি আছে? তখন একটা ছবি ছিল, ‘মনের মানুষ’। মোস্তফা মাহমুদের ছবি। রেডি একদম। আমি বললাম, দিচ্ছি আমরা। পনেরো দিন সময় দেন। উনি ওইখানে তাত্ক্ষণিক বললেন, সব ইন্ডিয়ান ছবির নেগেটিভ আর প্রিন্ট পুড়িয়ে দাও। এরপর একটার পর একটা ছবি আমরা রিলিজ করা শুরু করলাম।

আপনি তো ছবি প্রযোজনায়ও হাত দিলেন।

হ্যাঁ, স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’ করলাম।

প্রযোজনায় হাত দেওয়ার পর কি অভিনয় একটু কমিয়ে দিলেন?

না। তখন বছরে একটা করে ছবি প্রযোজনা করতাম। পরিচালক হলাম আমি ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিতে, ১৯৭৪ সালে। এটাতে একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার আছে। আমার একজন শ্রদ্ধেয় এডিটর ছিলেন বশীর সাহেব। তাঁর প্রডাকশন ছিল এটা। তিনি বললেন ডিরেকশন দিতে। তাঁর দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার হয়েছিল। তিনি জানতেন যে বেশিদিন বাঁচবেন না। তো তাঁর একটা অ্যাসেট দরকার ছিল। আমরা সবাই মিলে ছবিটা বানিয়ে দিয়েছিলাম।

আপনি তো অনেকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।

জাতীয় পুরস্কারে বেস্ট অ্যাক্টর পাঁচ কি ছয়বার পেয়েছি। তারপর আজীবন সম্মাননা পেয়েছি। লাস্ট যেটা বিরাট অ্যাচিভমেন্ট সেটা হলো স্বাধীনতা পুরস্কার। এটা দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার।

আপনার এক ছেলের জন্ম হয়েছিল কলকাতায়।

বাকি চারটির জন্ম এখানে। বড় ছেলে বাপ্পারাজ। ছোট ছেলে সম্রাট ছবি করে, নাটকের প্রডাকশন করছে। মেজো ছেলেটা হঠাৎ কানাডা গেছে ওর বাচ্চার কাছে। ওখানে পড়াশোনা করছে তো। বড় মেয়ে মারা গেছে। ছোট মেয়ে ময়না। ওর জামাই এয়ারফোর্সে আছে।

সব ছেলে-মেয়ের ঘরে নাতি-নাতনি আছে?

সব ছেলে-মেয়ের ঘরে নাতি-নাতনি আছে। আটটা নাতি-নাতনি। তার মধ্যে দুটো নাতি, বাকি সব নাতনি [হাসি]। আমার বউ সব সময় বলে, তুমি সারা জীবন আমাকে জ্বালিয়েছ। এখন এইগুলো এসেছে তোমাকে জ্বালাতে।

আপনার সহধর্মিণী তো কোনো দিন চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।

না। কোনো ইন্টারভিউ সে দেয়নি। একদম গৃহিণী। আমার লাক। তার একটা বিরাট কনট্রিবিউশন আছে।

শুনছি এখন একটা ডকুমেন্টারি ছবি করছেন।

একটা ডকুমেন্টারি আমার আছে। সেখানে দাফন-কাফন…

দাফন-কাফন কেন?

আমার শেষটা শুট করবে যারা, তারা যেন ওটার মধ্যে জয়েন করে দেয়। বাকি সব রেডি থাকবে। আমার লাইফের ওপর ছবি, এটা কী হবে জানি না।

এই ছবিটা হবে জীবনের শেষ ছবি?

হ্যাঁ, এটাই হবে আমার জীবনের শেষ ছবি।

অনুলিখন : আতিফ আতাউর