এফডিসির জোছনা বেগমের কষ্টের জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প!

খাবারের দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে বসে আছেন শান্ত। সাইনবোর্ডবিহীন এই দোকানের নাম জানতে হলো শান্তর কাছ থেকে—‘হালিম হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। শান্তর সামনের বেশ কয়েকটা টেবিল ও বেঞ্চ। সেখানে নানা বয়সী লোকজন দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। খাওয়া শেষ করে এসে বিল মেটাচ্ছেন কেউ কেউ। খানিক পরে শান্ত উঠে দাঁড়ালেন। চেয়ার ছেড়ে দিয়ে সামনে দাঁড়ালেন। চেয়ারে বসলেন একজন মধ্যবয়সী নারী। শান্ত পরিচয় করিয়ে দিলেন—‘আমার মা’। গত বছর এইচএসসি পাস করেছেন শান্ত।

হালিম হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের অবস্থান কারওয়ান বাজার রেলগেট পার হয়ে এফডিসির পাশে গাড়ি মেরামতের গ্যারেজগুলোর পেছনে। ‘এফডিসির খাবার’ বলে খ্যাত খাবার রান্না হয় এখানে। যে তিনটি হোটেল থেকে শুটিং স্পটে খাবার যায় এবং স্থানীয়রা ‘এফডিসি’র খাবার খান, তারই একটি হালিম হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। অন্য দুটির চেয়ে এখানে খাওয়ার পরিবেশও ভালো। তাই ভিড়টা বেশ।

খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে একেকজন আসছেন আর বিল দিচ্ছেন। শান্তর মা তাই ব্যস্ত। একবার সামনের টেবিলের ড্রয়ার খুলছেন, টাকা রাখছেন। ভাংতি ফেরত দিচ্ছেন। কাস্টমার টিস্যু পেপার চাইলে সেটাও হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

দুপুর গড়িয়ে এসেছে। এফডিসির খাবার তালিকায় বড় জায়গাজুড়ে থাকা ‘কালা ভুনা’ও শেষ ততক্ষণে। হোটেলের ভিড় খানিকটা কমে এসেছে। তবে এই ফাঁকে কথা হয়েছে শান্তর সঙ্গে। পুরো হোটেলটি শান্তর মা জোছনা বেগম দেখভাল করেন। প্রায় ১৫ বছর আগে শান্তর বাবা আবদুল হালিম হোটেলটা করেছিলেন বটে, কিন্তু বছর সাতেক ধরে তিনি বিছানায় পড়ে রয়েছেন। শরীরের এক পাশ অবশ তাঁর।

ভিড় কমে এলে মুখোমুখি বসি জোছনা বেগমের। শুরু করেন শুরুর গল্প। জোছনা বেগমের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। স্বামীর বাড়ি যশোরের কেশবপুরে। ঘটকের মাধ্যমে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। পাত্র হিসেবে আবদুল হালিমের বড় পরিচয় ছিল তিনি এফডিসির লোক। ‘এফডিসির লোক’ ব্যাপারটি পরিষ্কার করেন ছেলে শান্ত। ‘আমার বাবাকে এফডিসি এলাকার সবাই চেনেন। উনি একসময় সিনেমার প্রডাকশনে কাজ করতেন। তাই সবাই খুব পছন্দ করতেন। পরে হোটেল চালু করেছেন।’

ছেলের মুখের কথা টেনে নিয়ে জোছনা বেগম বলেন, ‘আমার বিয়ের পরে সবকিছু ভালোই চলছিল। বছর ঘুরতে ছেলে হলো। স্বামীকে সবাই চিনত বলে প্রতিদিন অনেক অর্ডার আসত। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেটা থেমে যায়।’ ততদিনে জোসনা বেগম তিন সন্তানের মা।

তারপর জমানো টাকা দিয়ে বছরখানেক স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছেন। এই হাসপাতাল থেকে সেই হাসপাতাল। কিন্তু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানো ছাড়া বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। তারপর একদিন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। সংসার তো চালাতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে স্বামীর ব্যবসায় হাত দেন জোছনা বেগম।

ব্যবসার হাল ধরার শুরুর দিকে গল্পগুলো মনে করে বলেন, ‘শান্তর বাবা অসুস্থ হওয়ার পর হোটেলের কর্মচারীরা সবাই চলে যায়। কারণ, তাদের তো আর বসে বসে বেতন দেওয়া সম্ভব নয়। বছরখানেক পরে আমি যখন নতুন করে শুরু করি, তখন তারা আরেক জায়গায় কাজ নিয়েছে। তাই নতুন নতুন কর্মচারী নিয়োগ দিতে হয়েছে। প্রচার করতে হয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে এগোচ্ছি।’

জোছনা বেগমের অধীনে এখন ১১ জন নিয়মিত কর্মী রয়েছেন এই দোকানে। তাঁদের কেউ বাজার করেন, কেউ রান্না, আর কেউ শুটিং বাড়িতে খাবার পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেন।

জোছনা বেগম বললেন, ‘এফডিসির খাবারের আলাদা কদর আছে সবার কাছে। এ কারণে আমাকেও বাড়তি খেয়াল রাখতে হয়। সকালে বাজারটা যেন ভালো হয়। রান্নাটা যেন ভালো হয় এমনকি পরিবেশনটাও যেন সুন্দর হয়।’

তাহলে সংসার?

‘সেটাও আমি দেখি। কাছেই বাসা। তাই সকালে রান্না বসিয়ে দিয়ে চলে যাই। দুপুরে এসে শুটিং বাড়িতে খাবার পাঠানো এবং হোটেলে আসা কাস্টমারদের খাওয়ানো দেখভাল করি। তারপর দুপুরের পর বাসায় গিয়ে বাচ্চাদের দেখাশোনা করি। বাড়তি পরিশ্রম হলেও করতে তো হবেই।’ বলেন জোছনা বেগম।

কথা বলার এক ফাঁকে শান্ত জানিয়ে রাখে, এখানে খাবারের দাম কিন্তু কম। সব প্যাকেজ সিস্টেম। ভাত, ডাল সবজি ও গরুর মাংস দিয়ে খেলে ১২০ টাকা। গরুর মাংসের জায়গায় মুরগি খেলে ৯০ টাকা এবং মাছ খেলে ৮০ টাকা। তবে অর্ডার করলে যেকোনো খাবারই রান্না করে দেওয়া হয়।

ছেলের কথা বলার ফাঁকে মা উঠে গেলেন। রান্নাঘরে গিয়ে বাবুর্চিকে বুঝিয়ে দিলেন, কীভাবে হাঁস রান্না করতে হবে। রান্নাঘরে গিয়ে ছয়টা চুলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হাসিমুখে জোছনা বেগম বললেন, ‘রাতে একটা হাঁস রান্নার অর্ডার আছে। সেটাই বলে দিচ্ছিলাম। রাতে তো অর্ডার ছাড়া রান্না হয় না এখানে।’

স্বামীর হঠাৎ অসুস্থতায় নিশ্চয়ই অশান্ত হয়ে গিয়েছিল জোছনা বেগমের জীবন। িকন্তু জোছনা বেগম থেমে যাননি। ব্যবসা, স্বামীর চিকিৎসা, সংসার এবং সন্তানদের মানুষ করে চলেছেন শান্তভাবেই। জীবনের অমাবস্যা নিজেই দূর করছেন জোছনা।- প্রথম আলো