কাতারের সঙ্গে কি সৌদি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে?

সৌদি আরবের নেতৃত্বে কাতারকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তাদের দাবি মানার জন্য চাপ দিচ্ছে চারটি উপসাগরীয় দেশ। কিন্তু এই সংকট সৃষ্টি করে তারা কি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে? বিশ্লেষকদের অনেকের ভয়, এসব পদক্ষেপ হয়তো পুরো অঞ্চলকেই এক বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিতে পারে। খবর বিবিসি বাংলা’র।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলেছেন, কাতারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে তাদেরকে যে ১৩টি শর্ত মেনে নিতে বলেছে উপসাগরীয় দেশগুলো, তা ‘পূরণ করা কঠিন’।

আলজাজিরা টিভি ও তুর্কি সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা, ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কমানো এবং সন্ত্রাসবাদকে কথিত সমর্থন দেয়া থামানোসহ ১৩টি দাবি মানতে কাতারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে সৌদি আরব, বাহরাইন, মিশর, ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
এটা বেশ স্পষ্ট যে, এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখছে সৌদি আরব। তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক এ প্রশ্ন করছেন, সৌদি আরব এক্ষেত্রে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে কিনা।

বিবিসি’র বিশ্লেষক ফ্রাংক গার্ডনার বলছেন, কাতারের পেছনে যে চারটি দেশ লেগেছে, এদের শাসকরা সবাই সুন্নি মুসলিম। তাদের চোখে ইরান এবং রাজনৈতিক ইসলাম ও সহিংস জিহাদ হচ্ছে তাদের জন্য দুটি বড় হুমকি। দেশগুলোর অভিযোগ, এই দুটি বিপদকেই উস্কে দিচ্ছে কাতার।

কাতারের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৩১ বছর বয়স্ক সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যাকে সংক্ষেপে ডাকা হয় এমবিএস বলে। অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলছেন, এমবিএস কি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন?

এটা ভাবার কারণ হলো- সৌদি আরবের নিজেরই সমস্যার শেষ নেই। তারা আমিরাতের সঙ্গে মিলে ইয়েমেনে দুবছর ধরে এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে জড়িত যার কোনো নিষ্পত্তির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া সৌদি আরবের শিয়া-প্রধান পূর্বাঞ্চলে বহুদিন ধরে বিদ্রোহী তৎপরতা চলছে।

সৌদি আরব ইসলামিক স্টেট বিরোধী মার্কিন কোয়ালিশনেরও সদস্য এবং আইএস দেশটির একাধিক মসজিদে বোমা হামলা চালিয়েছে।
এছাড়া, দীর্ঘমেয়াদে কাতারকে বিচ্ছিন্ন করার প্রতিক্রিয়া হবে অর্থনীতি ও ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর। ফলে যতই এ সমস্যা চলতে থাকবে, ততই এর অভিঘাত দেশ ছাড়িয়ে গোটা অঞ্চলের ওপর পড়বে।

কিন্তু সৌদি আরবের শাসকরা সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কড়া ইরানবিরোধী কথাবার্তায় উৎসাহিত হয়েছেন। তারা চান, তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের বিরুদ্ধে উপসাগরের দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হোক।

উপসাগরের রাজতন্ত্রগুলো রাজনৈতিক ইসলামকে তাদের জন্য বিপদ মনে করে। কেন, তা বোঝা খুবই সহজ।

কাতারের শাসক আল-থানির পরিবার দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক ছিল। ব্রাদারহুড চায় একটি নিখিল-ইসলামিক খিলাফত যা শেষ পর্যন্ত এখনকার শাসকদের উচ্ছেদ ঘটাবে।

মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া এবং গাজায় ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোকে সমর্থনও দিয়েছে কাতার। তাদের আলজাজিরা টিভি কাতারের ছাড়া সব আরব নেতাদের সমালোচকদের কথা বলার জায়গা দিয়েছে।

কিন্তু সন্ত্রাসবাদের বেলায় চিত্রটা বেশ অস্পষ্ট। সৌদি আরব বলে, কাতার সিরিয়া ও ইরাকে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে অর্থ দিচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, এ কথা ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়।

কারণ, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদকে উৎখাত করার চেষ্টায় সৌদি আরব নিজেই কোটি কোটি ডলার দিয়েছে সেখানকার সুন্নি যোদ্ধাদের যাদের কিছু অংশ শেষে ইসলামিক স্টেটে যোগ দিয়েছে। তবে কাতারের সঙ্গে যে আলকায়েদা সংশ্লিষ্ট আলনুসরার যোগাযোগ ছিল তা অস্বীকার করা যায় না।

তবে সৌদি নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার পরিণতিতে এখন কাতারের আকাশসীমা সমুদ্রপথ বন্ধ, আমদানি আটকে যাচ্ছে সীমান্তে এবং কাতারি অভিবাসীরা এসব দেশগুলো থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছেন।

গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল-জিসিসি’র মতো সংগঠন গড়ে আরব ঐক্যের যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল তা এখন খসে পড়তে শুরু করেছে। আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান কখনো যদি হয়ও, তাহলেও মধ্যপ্রাচ্য আর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না।