কেন সবসময় উলঙ্গ থাকেন এই লোক?

এক উলঙ্গ রাজার সন্ধান মিলেছে কোচবিহারে। নাম সুবল বর্মন। বয়স চল্লিশ। কোচবিহারের চান্দামারি পঞ্চায়েতের রাজাপুরে তার বাড়ি। এলাকায় ‘উলঙ্গ সুবল’ নামে বেশি পরিচিত। অনেকেই বলেন, ‘উলঙ্গ রাজা’। কলকাতার সংবাদ প্রতিদিনে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়েছে।

জন্মের পর থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত শরীরে এক টুকরো সুতো ওঠেনি সুবলের। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা উলঙ্গ থাকেন সুবল। গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে এসবই স্বাভাবিক। উলঙ্গ অবস্থায় কাজে যান এই রাজা। বাজার করেন। কখনও বাইকে ছুটে বেড়ান। আবার কখনও সাইকেল চালান। চা দোকানে আড্ডা দেন আর পাঁচজনের মতোই। কেউ তাঁকে নিয়ে কৌতুক করে না।

এক সময় স্থানীয়রা জামা— প্যান্টে অভ্যস্ত করতে কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু সুবলের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে প্রত্যেককে। কেন এমনটা? সুবল নিজেই জানালেন, ছোটবেলা থেকেই শরীরে সুতোর কিছু সহ্য হয় না। চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জামা—প্যান্ট পরলে কাঁপিয়ে জ্বর আসে। তাই হাল ছেড়ে ঠিক করেছেন উলঙ্গ থাকবেন। এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। শুধু কি জামা-প্যাণ্ট! বিছানাতেও নেই চাদর। তক্তার উপরে পলিথিন পাতা। রাতে বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। মাঘের শীতে যখন প্রত্যেকে কাবু হয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করে। জ্যাকেট, সোয়েটার, চাদরেও কাজ হয় না তখনও সুবল দিব্যি উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ান। চাদর, কম্বল কিছুই দরকার হয় না এই রাজার।

কষ্ট হয় না? প্রশ্ন শুনে হাসেন সুবল। বলেন, “সবই অভ্যাস বুঝলেন! আমার কোনও সমস্যা হয় না। অনেকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। লজ্জা পাই না। এভাবেই তো জন্মেছি। ” কিন্ত্ত দুঃখ নেহাত কম নেই। উলঙ্গ থাকার জন্য স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর। বড় হয়ে বয়স্ক শিক্ষার ‘নাইট স্কুল’-এ কয়েকদিন গিয়েছিলেন। সেখানেই যতটুকু শিখেছেন। ইংরেজি, বাংলা লিখতে ও পড়তে পারেন। নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি এই খেদ মেটাতে পড়শি এক ছেলের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। সন্তানসম গোকুল বর্মন এবার মাধ্যমিক পাস করেছে। অনেক দূর পড়াতে চান গোকুলকে। সুবল বলেন, “আমার হয়নি। এই ছেলেটার সমস্ত স্বপ্ন পূরণ করব। ”

সামান্য কিছু জমি থাকলেও আগে কলমিস্ত্রির কাজ করতেন তিনি। উলঙ্গ অবস্থায় কত বাড়িতে কলের কাজ করেছেন। কত জমিতে শ্যালো বসিয়েছেন তার হিসেব নেই। কেউ তাঁকে ঘিরে হইচই করেনি। এমনকী মহিলারাও নয়। এখন কল মিস্ত্রির কাজ ছেড়ে চান্দামারি মাছ বাজারের পিছনে একটি স্টল নিয়ে রান্নার গ্যাস এবং ওভেন ভাড়ার দোকান খুলেছেন। দিনের বেশি সময় দোকানেই থাকেন। কখনও খেতে সবজি চাষের কাজ করেন। তিনি জানিয়েছেন, এবার আট বিঘে জমির মধ্যে ছয় বিঘেতে পাট, পটল এবং কচু চাষ করেছেন। মাত্র দেড় বছর বয়সে বাবা লক্ষ্মীকান্ত বর্মনকে হারিয়েছেন সুবল। মা রাজোবালাদেবী প্রয়াত হয়েছেন ষোল বছর বয়সে। এরপর থেকে একা। বাড়িতে দু’বেলা নিজেই রান্না করেন। যেদিন শরীর ভাল থাকে না পড়শিদের বাজার করে দেন। ওরাই খাবারের ব্যবস্থা করে। বিয়ে করেননি কেন? প্রশ্ন শুনে হোহো করে হাসিতে ফেটে পড়েন বছর চল্লিশের যুবক। বলেন, “এই ন্যাংটো রাজাকে কে মেয়ে দেবে বলুন তো? তাছাড়া বিয়ের পরে অনেক দায়িত্ব থাকে। ওসব আমার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। তাই ঠিক করেছি একাই জীবন কাটিয়ে দেব। ” বৃদ্ধ হলে কী করবেন? তাঁর কথায়, “কেন পড়শি ও বন্ধুরা তো আছে। তাই ভয় করি না। ”

ছেলেবেলার নিজের হাডুডু খেলার দল ছিল। অনেক জায়গায় খেলতে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এছাড়াও ছিল কুষাণ গানের দল। বন্ধুদের সঙ্গে গান গেয়ে বেড়াতেন। আজও সেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মজে অবসর সময় কাটে। শহরে যান না? এবার কিছুটা অবাক হলেন উলঙ্গ রাজা। উল্টে প্রশ্ন করলেন, “কেন যাব না?” আপনাকে দেখে কেউ কিছু বলে না? সাবলীল উত্তর, “শহরের লোকজনের এত সময় নেই যে আমাকে নিয়ে পড়ে থাকবে। আমি দোকানের মালপত্র আনতে যাই। কাজ সেরে ফিরে আসি। কোনও সমস্যা হয় না। এছাড়াও শালবাড়ি, মোরোঙ্গাবাড়ি, গোসানিবাড়ি এলাকায় আত্মীয়দের বাড়িতে যাই। ”

সুবলবাবুর বন্ধু সন্তোষ দাস জানিয়েছেন, এক সময় জামা, প্যান্ট পরানোর অনেক চেষ্টা হয়। কম অত্যাচার চলেনি। নিরুপায় হয়ে তিনদিন নদীতে লুকিয়ে ছিল। প্রতিবেশী নৃপেন বর্মনের কথায়, “সুবল শিশুর মতো। ” সুমিত্র বর্মন, অনিমা বর্মনের মতো বধূরা জানিয়েছেন, বিয়ের পর বাড়ির পাশে উলঙ্গ ছেলেকে দেখে অস্বস্তি হত। লজ্জা লাগত। এখন কোনও সমস্যা হয় না। আর দশজনের মতোই ওকে মনে হয়।