গুমের হিসাব দিলেন রিজভী

আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন সময় গুম ও নিখোঁজ হওয়া নেতাকর্মীদের তালিকা প্রকাশ করলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির কাছে গুম ও নিখোঁজদের তালিকা চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ তালিকা প্রকাশ করেন তিনি। বিভিন্ন সংস্থা ও গুম হওয়া স্বজনদের বরাত দিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।

মঙ্গলবার বিকেলে নয়াপল্টন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক গুম ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ পান না অথচ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং গুম হওয়া পরিবার থেকে পাওয়া তথ্য মতে ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৪৩৫ ব্যক্তি গুম হয়েছেন। এর মধ্যে ২৫২ জনের এখনও হদিস পাওয়া যায়নি। ৩৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৩৪ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ২৭ জন বিভিন্ন সময়ে মুক্তি পেয়েছেন।

তিনি বলেন, গুম হওয়া মানুষের পরিবারগুলোর নীরব কান্না থেমে নেই। এগুলোর বিষয়ে কী কোনো জবাব দিতে পারবেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক? আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের চোখে পানি না আসলেও গুম হওয়া, খুন হওয়া, নির্যাতনের শিকার হওয়া স্বজন ও সহকর্মীদের চোখের পানিতে এখন বাংলাদেশ ভাসছে।

রিজভীর দেয়া তথ্য মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরে কেবলমাত্র ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থান ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে কমপক্ষে ৫০ জনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে পরিবারগুলো সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন।

তারা পুলিশ, র‌্যাব ও ডিবির কার্যালয়ে গিয়ে ধরণা দিয়েছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই বিএনপি বা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

‘বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে ৭০ দিন গুম করে রাখার পর ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ফেলে আসা হয়। আন্তর্জাতিক সব আইন-কানুন উপেক্ষা করে একটি বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত কী করে আরেকটি দেশের দুঃশাসন ও অন্যায়ের অংশীদার হতে পারে- আজ সারাবিশ্বের মানুষের মনে এ প্রশ্ন’- যোগ করেন রিজভী।

তিনি আরও বলেন, প্রতিদিনই অপেক্ষায় থাকেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য চৌধুরী আলম, সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হীরু, বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির পারভেজ, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদল সভাপতি আমিনুল ইসলাম জাকির, তেজগাঁও থানা বিএনপি নেতা সাজেদুল হক সুমন, সাজেদুলের খালাতো ভাই জাহিদুল করিম (তানভীর), পূর্ব নাখালপাড়ার আবদুল কাদের ভূঁইয়া (মাসুম), পশ্চিম নাখালপাড়ার মাজহারুল ইসলাম (রাসেল), মুগদাপাড়ার আসাদুজ্জামান (রানা), উত্তর বাড্ডার আল আমিন, বিমানবন্দর থানা ছাত্রদল নেতা এ এম আদনান চৌধুরী ও কাওসার আহমেদ, সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহাবুব হাসান, খালিদ হাসান (সোহেল) ও সম্রাট মোল্লা, জহিরুল ইসলাম (হাবিবুর বাশার জহির), পারভেজ হোসেন, মো. সোহেল (চঞ্চল), নিজাম উদ্দিন (মুন্না), তরিকুল ইসলাম (ঝন্টু), কাজী ফরহাদ, সেলিম রেজাকে (পিন্টু), ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন কুসুমসহ অনেকের হতভাগ্য পরিবার।

গুম হওয়া বিমানবন্দর থানা ছাত্রদলের সভাপতি এম এ আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমিন ছেলের অপেক্ষায় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে অসুস্থ হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। সরকারের সর্বশেষ আক্রোশের শিকার হয়েছেন বিশিষ্ট লেখক, কলামিস্ট, কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার। তিনি এখন এতোটাই মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত যে, শোনা যাচ্ছে মানুষজন ও আত্মীয়-স্বজনদের চিনতেও নাকি কষ্ট হচ্ছে তার। অথচ তার অপহরণ ঘটনা এখন নাটক বানাতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করেছে সরকার।

কিন্তু সরকারি কোনো চক্রান্ত ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনা ‘সাজানো নাটক’ হিসেবে মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারবে না। মানুষ যা বোঝার তা ইতোমধ্যেই বুঝে গেছেন- বলেন বিএনপি এ নেতা।

ওবায়দুল কাদেরের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনাদের নেতাকর্মীদের লুটপাটের টাকায় সুইস ব্যাংক জোয়ারের পানির মতো উপচে উঠেছে। তাই অন্যের আহাজারিতে আপনাদের মনে আনন্দ ধরে। সম্প্রতি দেশের মানুষ যখন পাহাড়ধসের মাটিচাপায় জীবন দিচ্ছে, দুর্যোগে-দুর্ভোগে বিপন্ন তখন আপনার নেত্রী লন্ডনে ভাগ্নিকে সংবর্ধনা দিতে যান। বর্তমানে দেশে উজানের পানিতে ভয়াবহ বন্যায় যখন মানুষ ভাসছে তখন আপনারা সংসদে বসে বিচারপতিদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে মেতে আছেন। সংসদে বসে মানুষের গীবত গাইছেন, যদি আপনারা প্রকৃত অর্থে জনপ্রতিনিধি হতেন, যদি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতেন তা হলে বন্যার্ত ও ক্ষুধার্ত মানুষের নিকট ত্রাণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।’

রিজভী বলেন, গুম হওয়া মানুষের স্বজনদের বেদনার্ত কান্নার আওয়াজ কাদের সাহেব আপনাদের কানে ঢোকে না। এমনকি সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কারও কর্ণ কুহরেই যেন এদের কান্নার শব্দ প্রবেশ করে না। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বজনেরা জানতেও পারেননি তারা এখন জীবিত নাকি মৃত। পিতার অপেক্ষায় তার সন্তান, স্বামীর অপেক্ষায় স্ত্রী, সন্তানের অপেক্ষায় মা-বাবা। এ অপেক্ষার যেন শেষ নেই।

বুকভরা বেদনা নিয়ে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে নিরাপত্তাজনিত আতঙ্ক। শুধু গুম আর অপহরণই নয়, বরং আওয়ামী লীগ ও তাদের পেটোয়া বাহিনীর হাতে নির্যাতিত লাখ লাখ মানুষ এখন কাঁদছে আর আওয়ামী নেতারা মানুষের দুঃখ-বেদনা ও কান্না নিয়ে উপহাস করছেন- যোগ করেন তিনি।