গুলশান হামলা : ৫ জঙ্গির খোঁজে মরিয়া পুলিশ

গুলশানের স্প্যানিশ রেস্টুরেন্ট হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলার মামলায় তদন্তকাজ শেষ দ্রুত শেষ করতে আরো পাঁচ জঙ্গিকে মরিয়া হয়ে খুঁজছে পুলিশ। তাদের মধ্যে অন্তত তিনজনকে গ্রেফতার করতে পারলেও তদন্ত শেষ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে গুলশান হামলার পরিকল্পনা ও এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পলাতক ওই পাঁচজন জঙ্গির বড় ধরণের ভূমিকা ছিল। মামলার তদন্ত শেষ করতে হলে ওই ৫ জঙ্গির অন্তত তিনজনকে গ্রেফতার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তারা হলেন- সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র্যাশ ও বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গি সোহেল মাহফুজ হলো গুলশান হামলার অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের মূলহোতা। সে জেএমবির পুরাতন ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল। জেএমবির শীর্ষ ৬ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হলে সংগঠনটির আমির হয় সাইদুর রহমান। ওই সময় জেএমবির শুরা (নীতি নির্ধারণী) কমিটির সদস্যপদ পায় মাহফুজ। ২০১০ সালের দিকে সাইদুর রহমান গ্রেফতার হয়। এরপর দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে উত্তরাঞ্চলে জেএমবিকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল মাহফুজ।

নারায়ণগঞ্জে নিহত নব্য জেএমবির সমন্বয়ক তামিম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। পরে সে নব্য জেএমবিতে যুক্ত হয়। এরপর থেকে সে নব্য জেএমবির অস্ত্র কেনা, গ্রেনেড তৈরি এবং সরবরাহসহ আইটি শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

আরেক জঙ্গি রাশেদ ওরফে র্যাশ গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে একজন। হামলাকারী ৫ জঙ্গি হামলার আগে রাজধানীর বসুন্ধরার যে বাসায় রাখা হয়েছিল ওই বাসায় রাশেদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল।

জঙ্গি বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট গুলশান হামলায় দুবাই থেকে আসা ১৪ লাখ টাকা বাংলাদেশে গ্রহণ করে বলে তথ্য রয়েছে তদন্ত সংস্থার কাছে। দুবাইয়ে পলাতক মুফতি শফিকুর রহমান নব্য জেএমবিকে নিয়মিত অর্থ সহায়তা করতো। বাশারুজ্জামান ওই অর্থ সংগ্রহ করে মূল সমন্বয়ক তামিমের কাছে দিতো।

বাকি দুই জঙ্গির একজন হলেন স্বপরিবারে সিরিয়ায় পলাতক ডাক্তার রোকন। গুলশানে জঙ্গি হামলার আগে নিউ জেএমবির তহবিলে টাকা দেয় ডাক্তার রোকন। সংগঠনটির শুরা বোর্ডের এক সদস্য টাকা গ্রহণ করে। দুই দেশ ঘুরে হাত বদল হয়ে এ টাকা বাংলাদেশে পৌঁছায়।
আরেক জঙ্গি ছোট মিজান গুলশান হামলাসহ নব্য জেএমবির দেশব্যাপী হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও গ্রেনেডের যোগানদাতা। পুলিশ জানায় দুই মিজানের নেতৃত্বে গুলশান হামলার অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহ করা হয়। তাদের দুই জনের বাড়িই চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তাদের একজন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান যাকে এরই মধ্যে গুলশান হামলার মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন ছোট মিজানকে খুঁজছে পুলিশ।

গুলশান হামলার মামলাটির তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, মামলটির তদন্ত করতে গিয়ে আমরা গত এক বছরে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ওই ঘটনায় সরাসরি যারা জড়িত ছিল অর্থাৎ যারা হামলা করেছিল তারা সবাই ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। এর বাইরে ওই ঘটনার পরিকল্পনা, সহযোগিতা করা বা নানাভাবে ভূমিকা রেখেছে এরকম অনেককে আমরা চিহ্নিত করেছিলাম। তাদের মধ্যে হলি আর্টিসানে হামলায় জড়িত ছিল এরকম আটজন গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে।

তিনি বলেন, মামলাটিতে গ্রেফতার করা হয়েছে চারজনকে, যাদের মধ্যে তিনজন নিজেদের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আর আমরা এখনো পাঁচজনকে খুঁজছি, তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ওই পাঁচজনের মধ্যে তিনজন এই মামলার তদন্তের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ আসামি। তাদের খুব বড় ধরণের ভূমিকা ছিল হামলার পরিকল্পনা ও এটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সাথে। তারা হলেন- সোহেল মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র্যাশ এবং বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট। তাদের ধরতে পারলেই তদন্তকাজ শেষ করতে পারবো।

মনিরুল ইসলাম বলেন, মামলার তদন্তকাজ অনেকটাই এগিয়েছে। মামলাটির তদন্তে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হলি আর্টিসানে হামলায় ভিকটিম যারা মারা গিয়েছে গত ১৯ জুন আমরা তাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। হামলাকারীদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এখনো হাতে পাইনি, সেটি প্রক্রিয়াধীন বলে আমরা জানতে পেরেছি। রিপোর্ট পেলে এবং অবশিষ্ট পাঁচজনকে অথবা তাদের মধ্যে দুই-একজনকে গ্রেফতার করতে পারলেই তদন্তকাজ শেষ করে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করার চেষ্টা করবো।

আরেক প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হাসনাত করিম এখনও এই মামলার সাসপেক্টেড আসামি। সে কারণেই তাকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং এখন সে কারাগারে আছে। তদন্ত শেষেই তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আমরা জানাতে পারবো।

প্রসঙ্গত, গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে শনিবার (১ জুলাই)। ভয়াবহ ওই হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ নাগরিক প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি, একজন ভারতীয়, ৯ জন ইতালীয় ও সাতজন জাপানি নাগরিক। প্রায় ১২ ঘণ্টার ওই ‘জিম্মি সংকট’ শেষ হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ দিয়ে।

অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। নিহত জঙ্গিরা হলেন- নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জল ওরফে বিকাশ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়ার এ হামলার নাম দেয়া হয় ঢাকা অ্যাটাক। ওই ঘটনার পরই দেশব্যাপী জঙ্গি বিরোধী অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।