চীনা ঋণের চোরাবালি ফাঁদে আটকে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের আগে ও পরে বাংলাদেশসহ অর্থনৈতিক দিক থেকে তুলনামূলক দুর্বল দেশগুলোকে চীনের আর্থিক সহায়তা করার বিষয়টি একই সঙ্গে চীন ও সাহায্যপ্রাপ্ত দেশগুলোর জন্য উপকারী। কিন্তু সাহায্য নিতে গিয়ে দেশগুলো ঋণের আরও গভীর ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছে কিনা, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।

বাংলাদেশ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবোর) প্রকল্পের বড় এক স্বত্ত্বভোগী। ভৌগলিক অবস্থান আর জ্বালানী আমদানি বিষয়ক সম্পর্কের জন্য চীনের এ প্রকল্পের অংশীদার বাংলাদেশ।

গত বছরের অক্টোবর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ১৩শ’ ৬০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি সই করে। এছাড়া আরও দু’হাজার কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়।

দু’দেশের সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে এই ঋণচুক্তিকে প্রথমে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সফট লোন বা নমনীয় ঋণ বলে উল্লেখ করা হয়।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, চুক্তি হওয়ার পর থেকেই এই ‘নমনীয়’ ঋণকে চীন সেটাকে ‘বাণিজ্যিক’ ঋণে রূপান্তর করার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সরকার থেকে সরকারের কাছেই এই ঋণগুলো যাবে, এমন কোনো প্রতিশ্রুতি চুক্তিতে দেয়া ছিল না।

এত বিশাল পরিমাণ অর্থ বাণিজ্যিক ঋণে রূপান্তর করা হলে তার বোঝা বহন ও শোধ করা খুব বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। তাই তখন থেকেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এর কড়া প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। এখনো বিষয়টি নিয়ে মীমাংসা হয়নি।

বাংলাদেশ ছাড়াও চীনের ঋণের ‘চোরাবালি’তে আটকে আছে অন্য অনেক দেশ। যার মধ্যে শ্রীলঙ্কার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসা দেশটির বর্তমান সরকার তার পূর্বসূরীর মতোই চেয়েছে চীনের আর্থিক সহায়তার ওপর নিজেদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সফল হয়নি।

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা বর্তমানে ৬ হাজার ৪শ’ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের তলায় আছে। ঋণ শোধের বোঝাটা সরকারি খাতের ওপর বিশাল চাপ ফেলছে। সরকারের ৯০ শতাংশ রাজস্বেই এই ঋণ শোধের পেছনে চলে যাচ্ছে। মোট ঋণের মধ্যে আর্থিক সহায়তা হিসেবে চীনের কাছে দেশটির ঋণ ৮শ’ কোটি ডলার বলে জানিয়েছে দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিঙ্গাপুর।

চীনের ঋণের তালিকায় মালয়েশিয়ার অবস্থানও ভালো নয়। দেশটির বিরোধী দলগুলো অনেক আগে থেকেই চীনের অর্থসাহায্যের ওপর সরকারের অতিনির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছে। বিশ্বব্যাংক ও মালয়েশিয়ার পরিসংখ্যান বিভাগের দেয়া তথ্য অনুসারে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত চীনা প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ার নানা অবকাঠামো প্রকল্পে ৩ হাজার ৫৬ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে।

চীনের এই আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টিকে বিশ্লেষকদের অনেকেই সমালোচনা করে বলছেন, এর মধ্য দিয়ে সাময়িক সুবিধার আশ্বাস দিয়ে তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর নিজের আর্থিক প্রভাব বাড়িয়ে ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করছে অর্থদাতা দেশটি। এতে সাহায্য পাওয়া দেশগুলো চীনের ঋণের বোঝার তলে চাপা পড়ে তার ওপর গলা চড়াতে পারবে না।

তবে অনেক বিশেষজ্ঞের আবার ধারণা, শুধু শুধু ক্ষমতা বাড়ানো চীনের উদ্দেশ্য নয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের সূত্র ধরে দেশটির তুলনায় আঞ্চলিক শক্তি বৃদ্ধি চীনের বড় একটি লক্ষ্য।