ছেলে সন্তানের জন্য হাহাকার কমছে, বাড়ছে কন্যাশিশুর প্রত্যাশা

মেয়ে সন্তান হয়েছে বলে অভিমানে স্ত্রীর মুখ দেখেননি, এমন গল্প আগে ঘরে ঘরেই শোনা যেত। ছেলে সন্তানের জন্ম যেখানে উৎসব, সেখানে মেয়ে শিশুর জন্ম মানেই ছিল শোকের পরিবেশ। তবে কন্যা শিশুর জন্য এখন সেই সময় বদলে অনেকটাই বদলে গেছে।

সম্প্রতি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন শারমিন আক্তার-আব্দুল্লাহ মামুন দম্পতি। মেয়ের মুখ দেখে যারপরনাই আনন্দিত তারা। এ বিষয়ে তাদের অনুভূতি জানতে চাইলে তারা জানান, একটা মেয়ে যেভাবে আমাদের বুঝবে, ছেলে তো সেভাবে বুঝবে না। প্রথম সন্তানটা মেয়েই হোক সেটাই চেয়েছিলাম, হলোও তাই।

একইভাবে মেয়ে সন্তান প্রত্যাশা করছিলেন আকাশ-মীরা দম্পতিও। কিন্তু তাদের হয়েছে ছেলে সন্তান। এতে অবশ্য কষ্ট নেই তার। তবে পরবর্তী সন্তানটি মেয়েই চান মীরা।

পরপর দুটি মেয়ের পর একটি ছেলে সন্তান চাইছিলেন মা বিউটি রানী। কিন্তু বাবা অরুণ বিশ্বাসের মেয়ে সন্তানই বেশি পছন্দ। তাই আবার মেয়ে সন্তানের জন্ম হওয়ায় অনেক খুশি তিনি।

ব্র্যাক ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটের পরিচালিত একটি গবেষণা বলছে, এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রতিবেশি দেশের তুলনায় সন্তানের লিঙ্গ নিয়ে চিন্তিত হবার প্রবণতা অনেক কম। অর্থাৎ যে সন্তানই আসুক তাকেই স্বাগত জানাতে চান তারা।

‘ডাইভারিং স্টোরিজ অব সন প্রেফারেন্স ইন সাউথ এশিয়া: এ কমপ্যারিজন অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্রে বাংলাদেশের আট জেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের কথা উঠে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, আগের তুলনায় এখনকার মা-বাবারা ছেলে ও মেয়ে সন্তানের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য করছেন না।

ওই জরিপে দেখা যা, ফরিদপুরের একটি গ্রামে ১৯৭৯ সালে ৩৪ বছরের কমবয়সী ৫৯ শতাংশ নারীরা ছেলে সন্তান চেয়েছিল। কিন্ত ২০০৯ সালে এসে সেই পরিমাণ ২০ থেকে ২২ শতাংশে নেমে আসে। এই গবেষণা মতে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের থেকেও ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারতে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করে মেয়ে সন্তান হলে গর্ভপাত করানোর প্রবণতা অনেক বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন: আগের তুলনায় বর্তমানে কন্যা শিশুর জন্য বাবা-মায়ের চাহিদা বেশ বেড়েছে। এখন আর মেয়ে সন্তান হলে খুব বেশি একটা নেতিবাচক চোখে দেখা যায় না।

‘তবে এই পরিবর্তনটা খুব কম সময়ে আসেনি। এক্ষেত্রে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, অর্থনীতি ও গ্রামীণ পরিবেশ খুব দরকারি ফ্যাক্টর। যারা দরিদ্র তাদের ভাবনা থাকে, মেয়েটাতো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তাহলে মেয়েটা বাবা-মাকে কিভাবে দেখবে। ছেলে হলে আর সেই সমস্যা থাকে না।

এই জায়গায় মেয়ে নিয়ে ভাবনায় একেবারে পরিববর্তন আসেনি। তবে এখন মেয়েরা ঘর থেকে বের হয়েছে। আবার অনেক মেয়েরা ঘরমুখীও হচ্ছে। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে বা সন্তান হওয়ার পরে চাকরি ছেড়ে দেয়। অনেক মেয়ে আছে যারা স্বামীরা অ্যাফোর্ড করতে পারলে চাকরি ছেড়ে দেয়।’

এই সমস্যার সমাধানের বিষয়ে তিনি বলেন: পরিবর্তন আনতে হলে বেশ কিছু জায়গায় নজর দিতে হবে। বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অংশগ্রহণ নেই। ফলে এই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। তাই সমস্যা সমাধানে পরিবার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ছেলে যেমন মেয়ের সঙ্গে ঘরে কাজ করবে, মেয়েও ছেলেদের মতোই সব ধরনের সুবিধা পাবে। সব সন্তানকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে দেখা যাবে সেই পরিবারের মেয়েরা অনেক ভিন্নভাবে বেড়ে উঠবে।

তবে মেয়ে সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের প্রত্যাশা তেমন বাড়েনি বলে মনে করেন ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস ও ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের হেড হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন: সারা দেশে নারীদের প্রতি যেসব সহিংসতা চলছে সেই কারণেও অনেকে মেয়ে সন্তান চায় না। মেয়েদের আমরা অনেক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে বড় করছি, এর সঙ্গে বাল্য বিয়ে তো আছেই।

‘একটি পরিবারে মেয়েরা যে পরিমাণ না শুনে বড় হয়, একটি ছেলে সেই পরিমাণ না শব্দ শুনে বড় হয়নি। ছেলেকে আমরা যে পরিমাণ সমর্থন দেই, মেয়েদের সেই পরিমাণ সমর্থন দিতে পারি না। এসব বিষয়সহ আরও অনেক ক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হলে এতটা সহিংসতা হতো না।’