জবির পরীক্ষাসূচি পেছাল, তবে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর

সোহান আহমেদ নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর পেছান হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বাংলা বিভাগের পরীক্ষাসূচি। সোহানের বন্ধুদের দাবি, সোহানসহ অসুস্থ শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে নির্ধারিত পরীক্ষার সময়সূচিতে পরিবর্তন আনলে প্রিয় বন্ধুকে তাদের হারাতে হতো না। সোহানের মৃত্যুর জন্য তারা পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাসকে দায়ী করেছেন।

অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অনিয়মিত ও নিজের খেয়ালখুশি মতো পাঠদান এবং শ্রেণিকক্ষে অশ্লীল কথাবার্তা বলারও অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা নাম প্রকাশ না করে জানান, ২৯ মে থেকে সোহানসহ ১১তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা শুরুর আগে প্রায় ২৫ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ কারণে তারা পরীক্ষা পেছানোর দাবি জানান। কিন্তু পরীক্ষা পেছানো হয়নি। ৮ জুন চতুর্থ পরীক্ষা দেয়ার পর আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন সোহান। ওইদিন বেশ কয়েকবার পরীক্ষার হলে মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি। ৯ জুন (শুক্রবার) মানিকনগরে খালাতো ভাইয়ের বাসায় মারা যান সোহান।

সোহানের মৃত্যুর পর ১১ জুন নাজমুল নামে অপর এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই ঘটনার পর ফের পরীক্ষা পেছানোর আবেদন করেন শিক্ষার্থীরা। অবশেষে ১২ জুনের পরীক্ষা পিছিয়ে ১৩ জুলাই নেয়া হবে বলে জানায় দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা কমিটির সভাপতি মিল্টন বিশ্বাস।

সোহানের একাধিক সহপাঠী অভিযোগ করে বলেন, আমাদের দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার পর সোহানসহ অন্তত ২৫ শিক্ষার্থী চিকুনগুনিয়া ও সাধারণ জ্বরে আক্রান্ত। আমরা পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও বিভাগের শিক্ষক ড. মিল্টন বিশ্বাস স্যারের কাছে শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে পরীক্ষার নতুন সময়সূচি দেয়ার আবেদন জানাই। কিন্তু মিল্টন স্যার পূর্বের সূচিতেই পরীক্ষা নেয়া হবে বলে জানিয়ে দেন।

পরে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আখতারুজ্জামান স্যারের শরণাপন্ন হলে তিনি পরীক্ষা পেছানোর আশ্বাস দেন বলে জানান শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, বিভাগ থেকে পরীক্ষা পেছানোর কোনো সহযোগিতা না পেয়ে আমরা কন্ট্রোলার স্যারের সঙ্গে দেখা করলে তিনি পরীক্ষা পেছানোর আশ্বাস দেন এবং তাৎক্ষণিক ভিসি স্যারের সঙ্গে কথা বলে পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানান।

অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, পরীক্ষা পেছানোর জন্য আমরা বেশ কয়েকবার মিল্টন স্যারের কাছে যাই। কিন্তু তিনি তিরস্কার করে আমাদের বলেন, ‘বন্ধুর জন্য দরদ উৎলাইয়া পড়ছে, তাই না। যাও পরীক্ষা হবেই। কাল এসে পরীক্ষা দিবা।’ এভাবেই পরীক্ষা চলতে থাকে এবং পরীক্ষা চলাকালে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে সোহান।

সোহানের চিকিৎসা সম্পর্কে সহপাঠীরা জানান, গত ২০ এপ্রিল সোহানকে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান, তার ভাইরাস জ্বর হয়েছে। সেখানে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ভর্তি থাকার পর সম্পূর্ণ বিশ্রামের নির্দেশনা দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেন চিকিৎসকরা।

অসুস্থতার কারণে ৮ জুন (বৃহস্পতিবার) মনোয়ারা মেডিকেল কলেজে আবারও সোহানকে ভর্তি করা হয়। ওখানে তাকে ব্যথার ইনজেকশন দেয়া হয় এবং শারীরিক অবস্থার কিছু উন্নতি হলে খালাতো ভাইয়ের বাসায় নেয়া হয়। সেখানে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লে মানিকনগরে তাওহীদা জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সোহান নাটোরের দয়রামপুর কাদিরাবাদ সেনানিবাস এলাকার জৈয়ান্তাপুর গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে। সোহানের বড় ভাই খোকন বলেন, ‘সোহানের মৃত্যুর পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি। অসুস্থ অবস্থায় আমাদের এক খালাতো ভাই ও কয়েকজন বন্ধু তার দেখাশোনা করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় যাবার পর মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তো সোহান। ভাইটা আমার চাপা ছিল। সে সবকিছু নিয়েই ভাবতো। পারিবারিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা। ভাইটা আমার চলে গেল। সে কখনই বলতো না, আমার এ সমস্যা, ওই সমস্যা।’

শিক্ষার্থীরা জানান, যেখানে জবির আবাসন ব্যবস্থা নেই সেখানে ক্যাম্পাস ১ জুন ছুটি ঘোষণা করার পর পরীক্ষা দেয়ার জন্য তাদের থাকতে বাধ্য করা হয়। জোর করে পরীক্ষা না নিলে সোহান বাসায় চলে যেত। হয়তো সে আজও বেঁচে থাকতো তাদের মাঝে।

বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মিল্টন বিশ্বাস (পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক) কখনো ঠিক সময় শ্রেণিকক্ষে আসেন না। দেড় ঘণ্টার ক্লাস ৫ থেকে ১০ মিনিটের বেশি নেন না। অধিকাংশ সময় শিক্ষার্থীদের শ্রেণিপ্রতিনিধিদের দিয়ে হাজিরা খাতা নিয়ে স্বাক্ষর করেন তিনি। এছাড়া তিনি ক্লাসে অশ্লীল কথাবার্তাও বলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দফতর থেকে জানা গেছে, গত ১ জুন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে ১৫ জুন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দফতর ও অফিস খোলা রাখা হয়।

এ বিষয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আরজুমন্দ আরা বানু বলেন, ‘পরীক্ষা নেয়া বা না নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ পরীক্ষা কমিটির সভাপতির এখতিয়ার। আমি এ বিষয়ে আর কিছু জানি না।’

সোহানের মৃত্যু ও ১১তম ব্যাচের পরীক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘আমার জানা মতে এমন কিছু ঘটেনি। আর অভিযোগের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’

এর আগে অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কয়েকজন শিক্ষার্থী আমার কাছে এসেছিল। আমি বলেছি, পরীক্ষার তারিখ চূড়ান্ত হয়েছে, পরীক্ষা হবে। আর একজন শিক্ষার্থী মারা গেছে এতে পরীক্ষার সঙ্গে কী সম্পর্ক!’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ কে আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমার কাছে বাংলা বিভাগের ১১তম ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী এসেছিল। আমি তাদের সামনেই উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলি। একটি ব্যাচের এতো শিক্ষার্থী অসুস্থ, পরীক্ষাটা পেছানো যেত। শুনলাম এক পরীক্ষার্থী মারা যাওয়ার পর পরীক্ষা পেছানো হয়েছে। এটা কেন করা হলো? আগেই তো এটা করা যেত!’