বন্যা : ঝুঁকির মুখে ঢাকা রক্ষা বাঁধ, পূর্বাঞ্চল সম্পূর্ণ অরক্ষিত

বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজধানী ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বাঁধ নির্মাণের জন্য যে পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তার অধিকাংশ জমিই এখনও বেদখলে রয়েছে। আবার সংস্কারের অভাবে বাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। ফলে এই বাঁধ রয়েছে ঝুঁকির মুখে। অন্যদিকে, রাজধানীর পূর্বাঞ্চল একেবারেই অরক্ষিত। ‘ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বাইপাস’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় যেকোনও রাজধানী ঢাকা খুব সহজেই বন্যাকবলিত হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, ১৯৮৮ সালের বন্যায় রাজধানী ঢাকা আক্রান্ত হয়। এরপর ঢাকা জেলা রক্ষা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সেই উদ্যোগেই মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন থেকে ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের নবাবগঞ্জ, হাজারিবাগ, গাবতলী, মিরপুর হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলে ১৯৯৮, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হলেও রাজধানী ঢাকায় বন্যার পানি ঢুকতে পারেনি। তবে সংস্কারের অভাবে এই বাঁধের ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কাশিয়াখালী বেড়িবাঁধসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। এতে পুরো বাঁধ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, ঢাকা সমন্বিত বাঁধ প্রকল্পের আওতায় আবদুল্লাহপুর থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ৩৫ দশমিক ৬৩০ কিলোমিটার জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে মোট ৬৪২ দশমিক ২০ একর জমির মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে ৪৬৩ দশমিক ৭০ একর। অব্যবহৃত ১৭৮ দশমিক ৫০ একরের মধ্যে বর্তমানে অধিকাংশ জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। সিটি জরিপে অধিগ্রহণের তুলনায় কম রেকর্ড হয়েছে। সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকের কার্যবিবরণীতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ওই বিবরণী থেকে আরও জানা গেছে, এক হাজার ৮১ অবৈধ দখলদারের তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে।

ওই বৈঠকে বেদখল হওয়া এসব জমি দ্রুত উদ্ধারে অভিযান শুরুর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বাঁধের জমি রক্ষণাবেক্ষণে একটি পৃথক কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন তারা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এর মধ্যে চলতি বছরের ২১ জুলাই ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জের কাশিয়াখালীতে বাঁধের সোনাবাজু বাজার অংশে ঢাকা রক্ষা বাঁধ সংস্কার ও স্লুইস গেট নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন ও ক্যাম্পেইন করেছে এলাকাবাসী। তাদের অভিযোগ, ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম নদী ভাঙন ও বন্যা থেকে রক্ষার জন্য নির্মিত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কাশিয়াখালী বেড়িবাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। টানা বৃষ্টি ও পদ্মার পানির চাপে বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছে।

ঢাকাকে বন্যা থেকে রক্ষা করার জন্য এই বাঁধটি নির্মাণের কথা বলা হলেও ঢাকার অর্ধেকেরও বেশি এলাকা এখনও অরক্ষিত। বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের ১৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা বাঁধের কারণে খানিকটা সুরক্ষিত হলেও এখনও পূর্বাঞ্চলের ১২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা অরক্ষিত রয়েছে। ফলে এ অঞ্চল দিয়ে বন্যার পানি অনায়াসে ঢাকায় ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে, ষাটের দশকে তৈরি করা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) বাঁধের কারণে ১৯৮৮ সালের বন্যায় যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, চাষাড়া, ফতুল্লা ও পাগলার বিশাল এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বর্তমানেও প্রায় সারাবছর এই এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এই বাঁধকে ঘিরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বাইপাস’ নামে প্রকল্পের পরিকল্পনা করে। কিন্তু ২০০৫ সালের দিকে বিএনপি সরকারের সময়ে অর্থ না পাওয়ার অজুহাতে সেই প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার তিনশ ফিট সড়কটি নির্মাণ করে। বর্তমানে পুরো এলাকা অরক্ষিত থাকায় পূর্বাচল উপ-শহর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিউটিএ) সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) নির্বাহী সদস্য ও নগর বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘১৯৮৮ সালের বন্যার পর বুয়েটের পরামর্শে ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এখন বাঁধটি যেমন নিজেই আত্মহত্যা করেছে, ঠিক তাকে হত্যাও করা হয়েছে। বাঁধের কোথাও কোথাও খসে পড়েছে। আবার কোথাও কোথাও বাঁধের জমি দখল করে দোকান-পাট গড়ে তোলা হয়েছে। আবার পূর্ব ঢাকায় তো বন্যার পানি প্রতিরোধে কোনও ব্যবস্থাই নেই।’

এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘ঢাকাকে বন্যা থেকে বাঁচাতে হলে পশ্চিমাঞ্চলের মতো পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ নির্মাণের কোনও বিকল্প নেই। এটা আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। আগের বছরগুলোতে বন্যার পানি ঢাকায় ঢোকেনি। তবে সিলেট-মেঘালয় অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে মেঘনা-কুশিয়ারা হয়ে পানি ঢাকার পূর্বাংশে ঢুকে যেতে পারে। আর ঢাকায় একবার পানি ঢুকে পড়লে সেই পানি আর সহজে বের হতে পারবে না। কারণ আমরা পানি বের হওয়ার সব রাস্তাই বন্ধ করে ফেলেছি।’

এদিকে, বুধবার (১৬ আগস্ট) বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সর্বশেষ বিশেষ বুলেটিনে আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টায় উজানে পানি বাড়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। ওই বুলেটিনে বলা হয়েছে, দেশের মধ্যাঞ্চলে রাজধানীর চারপাশের পাঁচ নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর পানি কিছু কিছু পয়েন্টে কমতে শুরু করলেও অনেক পয়েন্টেই বাড়ছে। পানি আরেকটু বাড়লেই রাজধানী প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকৌশলীরা।

পাউবোর একাধিক প্রকৌশলী বলেন, আগের বন্যাগুলোতেও দেখা গেছে, পূর্বাঞ্চল দিয়েই রাজধানীতে পানি ঢুকেছে। অথচ সেই এলাকা এখনও অরক্ষিত। পূর্বাঞ্চলীয় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকাকে বন্যা থেকে রক্ষা করা যাবে বলে অভিমত দেন তারা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইফুল হোসেন বন্যায় ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীসহ ঢাকার আশপাশের পাঁচটি নদীর পানি বিপদসীমার নিচে রয়েছে। তবে প্রতিদিনই পানি বাড়ছে। এখন যদি উজানের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ঢাকা বন্যা থেকে রক্ষা পাবে। আর সেটা না হলে ঢাকার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’-প্রতিবেদন বাংলা ট্রিবিউনের সৌজন্যে প্রকাশিত।