টালিগঞ্জের রাজু থেকে যেভাবে হয়ে উঠেন বাংলাদেশের নায়করাজ

নায়ক রাজ বলতে ঢাকায় এক জনকেই বোঝানো হয় আর তিনি হচ্ছেন চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তী রাজ্জাক। যে মানুষটি একাধারে একজন অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে ভূমিকা পালন যাচ্ছেন। তিনি কিশোর বয়সে কলকাতার মঞ্চ নাটকে জড়িয় পরেন।

এর পর ১৯৬৪ সালে আলে দাঙ্গার উত্তাল সময়ে নতুন জীবন গড়তে একজন সাধারন মানুষ হিসাবে আবদুর রাজ্জাক পরিবার সহ ঢাকায় চলে আসেন প্রায় অসহায় অবস্থায়। কঠোর পরিশ্রম আর জীবনের প্রতিটি মহুর্তের সাথে সংগ্রাম করে উপাধি পেয়েছেন আজকের নায়ক রাজ নাজ্জাক।

তবে রাজ্জাক তৎকালীন সময়েও দর্শকের কাছে জনপ্রিয় ছিল। আর এই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন পাকিস্তান টেলিভিলশনে ঘরোয়া নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়। জীবনে নানা সংগ্রামের পথ অতিক্রম করে তিনি। তারপর আব্দুল জব্বার খানের সহযোগিতায় তিনি একবাল ফিল্মে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। তিনি উজালা ছবিতে কাজ শুরু করেন পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারী হিসাবে।

এরপর সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের তেরো নাম্বার ফেকু অস্তাগড় লেন চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তীতে কার বউ, ডাক বাবু, আখেরী স্টেশনসহ আরও বেশ কটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করে তিনি। পরে বেহুলা চলচ্চিত্রে সুচন্দার বিপরীতে তিনি নায়ক হিসেবে ঢালিউডে উপস্থিত হন এবং সবার মন জয় করে নেন।

দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি নায়করাজ হিসেবে পরিচিতি পান। কি যে করি ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেছেন। এই প্রযন্ত তিনি চার বার জাতীয় সম্মাননা লাভ করেন। চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তী হয়েছেন, এটা যে কারো কাছেই গল্প বলে মনে হতে পারে। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

রাজ্জাক অসীম মনোবল, অমানুষিক পরিশ্রম আর মমতার মাধ্যমে ঠিকই নিজের লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। রাজ্জাকের জন্ম কলকাতার সিনেমাপাড়া টালিগঞ্জে। অর্থাৎ জন্মের পর থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে সখ্যতা। মঞ্চের সঙ্গে জড়িত থাকলেও স্বপ্ন ছিল সিনেমাকে ঘিরে। টালিগঞ্জের সিনেমাশিল্পে তখন ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সৌমিত্র, বিশ্বজিতদের যুগ।

সেখানে হালকা-পাতলা সাধারণ রাজুর অভিনয় সুযোগ পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এর মধ্যে শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক সময় কলকাতায় থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। তখন এক সুহৃদ রাজ্জাককে পরামর্শ দিলেন ঢাকায় চলে আসতে। বললেন, ঢাকার চলচ্চিত্র নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। সেখানে গেলে হয়তো কিছু একটা হবে।

ভদ্রলোক ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা আবদুল জব্বার খানের পরিচিত। তিনি রাজ্জাককে পাঠালেন তার কাছে একটা চিঠি দিয়ে। তিনি রাজ্জাক কে বলে দিলেন ঢাকার কমলাপুরে থাকেন আবদুল জব্বার খান। তখন রাজ্জাক প্রথম এসে কমলা পুরে বাসা নেন। এর পর চিঠি নিয়ে জব্বার খানের কাছে যান তিনি রাজ্জাককে একবাল ফিল্ম লিমিটেড এর কাজ করার সুযোগ করে দেন।

উজালা ছবির মধ্যদিয়ে রাজ্জাকের শুরু হল ঢাকার চলচ্চিত্র জীবন। পরিচালকের পাশাপাশি বেশ কিছু ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। এসব ছবির মধ্যে ডাক বাবু, ১৩নং ফেকু ওস্তাগার লেন, আখেরী স্টেশন উল্লেখযোগ্য। পর্যায় ক্রোমে তিনি জহির রায়হানের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দান করেন। আর তখন থেকেই তার ভাগ্য খুলে যায়।

সহকারী হিসাবে কয়েকটি ছবি পরিচালনা করার পর হঠাৎ এক দিন তিনি নায়ক হওয়ার সুযোগ পান। লোক কাহিনী নিয়ে জহির রায়হান তখন বেহুলা ছবির নির্মান কাজ করতেছেন। জহির রায়হান তাকে বলল আপনিই আমার ছবির নায়ক। ঐসময় রাজ্জাকের চেহারার মধ্যে কলকাতার বিশ্বজিৎ-এর ছায়া খুজে পাওয়া যেত। জহির রায়হানের সুনিপুণ হাতের ছোয়ায় অসাধারন লক্ষ্মীন্দর হয়ে দর্শকেদের সামনে উপস্থিত হলেন রাজ্জাক।

তার বিপরীতে অভিনয় করেছে অপূর্ব সুন্দরী বেহুলারূপী সুচন্দা। বেহুলা ছবিটি ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। দর্শকের কাছে ছবিটি সুপার হিট হয়। এই ছবির মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পায় আরেক জন নায়ক যিনি চলচ্চিত্র শিল্পের অপরিহার্য নায়ক। ঢাকার সিনামা হল গুলোতে তখন পাক-ভারতীয় ছবির দাপট।

পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী, জেবা, সুধির, শামীম আরা, ওয়াহিদ মুরাদ এবং কলকাতার ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, বিশ্বজিৎ, সৌমিত্র এবং ভরতের রাজ কাপুর, নার্গিম, দিলীপ কুমার এদের ছবির সঙ্গে পালা দিয়ে চলতে শুরু করল ঢাকার নির্মাতাদের নির্মিত ছবি। আব্দুল জব্বার খান, রহমান, শবনম, খলিল, ফতেহ লোহানী, খান আতা, সুমিতা দেবী, আনোয়ার হোসেন, সুচন্দা তাদের সাথে আরো একটি নাম যোগ হল আর তা হচ্ছে আর তিনি হলেন রাজ্জাক।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এখানে নির্মিত বেশিরভাগ ছবির নায়ক রাজ্জাক। দুই ভাই, আবির্ভাব, বাঁশরী, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নীচে, যে আগুনে পুড়ি, পায়েল, দর্পচূর্ণ, যোগ বিয়োগ, ছদ্মবেশী, জীবন থেকে নেয়া, মধুর মিলন ইত্যাদি ছবির সাফল্যে রাজ্জাক হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অপরিহার্য নায়ক। দেশ যখন পাকিস্তান থেকে ভাগ হয়ে যায় তখন বাংলাদেশে পাক ভারতীয় ছবির প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়।

এমন অবস্থায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাদের উপর দয়িত্ব পরে রাজ্জাক তাদের মধ্যে এক জন। এর পর সড়ক দুর্ঘটনায় রহমান পা হারালে চলচ্চিত্রে রোমান্টিক নায়কের শূন্যতা দেখা দেয়। তখন রাজ্জাক একাই তা সামাল দেন। খুব দক্ষতা এবং নৈপুন্যতার সাথে রাজ্জাক একের পর এক ছবিতে অভিনয় করে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম মুক্তি পায় রাজ্জাক অভিনিত মানুষের মন ছবি।

ছবিটি ব্যবসা সফল হওয়ার কারনে নতুন ভাবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে জেগে উঠে। ছবিটি পরিচালনা করেন মোস্তফা মাহমুদ। এই ছবির মধ্য দিয়ে শুরু হল চলচ্চিত্রে নায়ক রাজ্জাকের যুগ। তার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম ছবি চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ওরা ১১ জন, এসএম শফির ছন্দ হারিয়ে গেল, বাবুল চৌধুরীর প্রতিশোধ এবং কাজী জহিরের অবুঝ মন ছবিতে অভিনয় করে রাজ্জাক হয়ে যান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আইকন।

১৯৭৩ সালে জহিরুল হকের রংবাজ ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করে রাজ্জাক বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি সূচনা করেন চলচ্চিত্রের আধুনিক অ্যাকশন যুগেরও। রংবাজ দিয়েই রাজ্জাক তার অভিনয় জীবনে বৈচিত্র নিয়ে আসেন। রাজ্জাক বলেন, রংবাজ ছবির সাফল্যের পর আমার মনে হলো, দর্শকদের একঘেয়েমি থেকে মুক্ত রাখতে হলে সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। প্রয়োজনে দর্শকদের জন্য নিজের অর্থে ছবি নির্মাণ করতে হবে।

তিনি আরো জানান যে প্রযোজক হিসাবে আত্নপ্রকাশ করার আগে আমি আরো কিছু বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করেছি। যেমন; বেঈমান, অনির্বান, স্লোগান, ঝড়ের পাখি, আলোর মিছিল, এখানে আকাশ নীল, অতিথি, অবাক পৃথিবী, উল্লেখযোগ্য।

শুধু অ্যাকশান, রোমান্টিক নয় ত্রিরত্নের মতো কমেডি ছবিতেও অভিনয় করেছি। আমি চেয়েছি দর্শকদের আনন্দ দিতে। আপনি লক্ষ্য করবেন, আজিজুর রহমানের অতিথি ছবিতে আমি সেক্রিফাইসিং চরিত্রে অভিনয় করেছি। এসময় আলমগীর নতুন অভিনেতা। তাকে তুলে ধরার জন্য শাবানার সঙ্গে রোমান্টিক চরিত্রে আমি মিলিয়ে নিয়েছি।

অনুরূপ ভাবে নারায়ন ঘোষ মিতার আলোর মিছিল ছবিতে আমি ফারুককে রোমান্টিক চরিত্রে মেনে নিয়েছি। কারন আমার উদ্দেশ্য ছিল নতুন নায়ক হলে আমার উপর চাপ কমবে। আমার কাছে খুবই ভালো লাগে যে তার উভয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পেরেছে। চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখেছে। ১৯৭৪ সালে নতুন পরিচালক মাসুদ পারভেজ পরিচালিত মাসুদ রানা এতে আমি অতিথি শিপ্লী হিসেবে একটি গানের দৃশ্যে অভিনয় করেছি।

এতে নায়ক হিসাবে অভিনয় করে সোহেল রানা, তার জীবনেও এটি প্রথম ছবি। ছবিটিতে মনের রঙে রাঙাব বনের ঘুম ভাঙাব গানের সাথে নেচে গেয়ে আরেক জন নতুন শিল্পীর উত্তরনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছি। এই সময় আমি যে অবস্থানে ছিলাম কোন নতুন নায়কের ছবিতে অতিথি শিল্পী হিসেবে কাজ করার কথা নয়। বর্তমান প্রজম্মের কোন জনপ্রিয় নায়ক আমার মত করবে না। আর আমি করার কারন হচ্ছে আমাদের চলচ্চিত্র জগতে নায়ক নায়িকাদের সংখা বাড়িয়ে চলচ্চিত্রকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

অভিনেতা হিসেবে নিজেকে অন্য সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজ্জাককে তেমন কোনো কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়নি। রাজ্জাক বরাবরই মানুষকে যথাযোগ্য সম্মান আর ভালোবাসা দিয়েছেন। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নামীদামী প্রযোজক-পরিচালকদের সম্মানে পার্টির আয়োজন করেছেন বছরের পর বছর। রাজ্জাকের স্ত্রী লক্ষী রাত জেগে স্বামীর বন্ধুদের পছন্দ মতো রান্নাবান্না করে খাইয়েছেন। নির্মাতারাই তাকে নিয়েছে-বাদি থেকে বেগম, সমাধি, কি যে করি, সেতু, আগুন-এর মতো জনপ্রিয় ছবির সেরা চরিত্রে।

এক সময় পরিচালকগন মনে করতেন পর্দায় নায়ক মারা গেলে ছবি চলবেনা। ঠিক এমন সময়ই বেঈমান, সমাধি আর সেতু ছবির শেষ দৃশ্যে রাজ্জাক মৃত্যুবরন করেন, এতে দর্শকদের খুব কষ্ট দিয়েছেন ঠিকই তবে ছবির সাফল্যও আদায় করে নিয়েছেন। বর্তমানে বাংলা ছবির নায়ক মানেই চকচকে শার্ট-প্যান্ট, স্যুট-টাই পরা। কিন্তু ঐ সময় রাজ্জাক অভিনয় করত ছাপার লুঙ্গি পরে, চরিত্রের প্রয়োজনটা বোঝার ক্ষমতাটাই রাজ্জাককে নায়নরাজে পরিণত করেছে।

১৯৭৭ সালে রাজ্জাক যখন পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, তখন তিনি বেছে নেন প্রেমের গল্পকে। ছবি করেন অনন্ত প্রেম এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন ববিতা। গল্প, গান, চিত্রায়ন, অভিনয় সবকিছু মিলিয়ে ছবিতে তারা দর্শকদের যা উপহার দিয়েছে দর্শক কি তা কখনো ভূলতে পারবেন? প্রেমের ছবির মূলমন্ত্র হচ্ছে মান অভিমান, প্রেম ভালোবাসা এবং সর্বশেষে মিলন। এসব ছবি দেখে দর্শক হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরেন।

কিন্তু অনন্ত প্রেম ছবিতে নায়ক-নায়িকার মৃত্যু দিয়ে ছবি শেষ করেও সাফল্য অর্জন করে রাজ্জাক প্রমান করে পরিচালক হিসাবেও তিনি দর্শকের মন জয় করতে পারেন। তারপর বদনাম, সৎ ভাই, চাপাডাঙ্গার বউ এবং বাবা কেন চাকর নির্মাণ করে পরিচালক হিসেবে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করে নেন। বিশেষ করে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপাডাঙ্গার বউ ছবিটি নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি অভিনেতা রাজ্জাককে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রে শাবানার বিপরীতে এটিএম শামসুজ্জামানকে নিয়ে একজন অভিনেতার মহত্ব প্রমাণ করেছেন।

এই ছবিটির প্রযোজক তিনি, পরিচালকও তিনি, এই ছবিতে ঐ সময়ের জনপ্রিয় নায়িকা শাবানাকে নিয়েছেন নাম ভূমিকায় পূত্র বাপ্পারাজকে দিয়েছেন নায়ক হিসেবে এবং যাত্রা সম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাসের কন্যা অরুনা বিশ্বাকেও নিয়েছেন নায়িকা হিসাবে, তিনি ইচ্ছা করলে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন, প্রধান চরিত্রে নিয়েছেন খল অভিনেতা তার বন্ধু এটিএম শামসুজ্জামনকে। এখানেই পরিচয় হয় রাজ্জাকের অতুলনীয় এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মনোভাব।

অভিনেতা রাজ্জাকের বৈচিত্রময় সাহসী চরিত্রে অভিনয়ের কথা স্মরনীয় হয়ে আছে। ১৯৭৮ সালে রাজ্জাক যখন খুবই জনপ্রিয় এক অভিনেতা তখনও তিনি আজিজুর রহমানের অশিক্ষিত ছবিতে গ্রামের পাহারাদার চরিত্রে অভিনয় করেছেন, লুঙ্গি আর শার্ট পরে, যা আজো মনে পরে। ছবিটির শেষ দিকে মাস্টার সুমনের মৃত্যু পর পুলিশের খাতায় রাজ্জাকের স্বাক্ষর করার দৃশ্য আজও মনে পরলে চোখে পানি এসে যায়। এর দুই বছর পর একই পরিচালক আজিজুর রহমানের ছুটির ঘণ্টা ছবিতে স্কুলের দপ্তরির চরিত্রে রাজ্জাকের অসাধারণ অভিনয় কি মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব?

বড় কথা ওই সময় যে অবস্থানে থেকে রাজ্জাক পাহারাদার কিংবা স্কুলের দপ্তরির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেটা আজকের কোনো জনপ্রিয় নায়কের কাছ থেকে আশা করা যায়? এদিকে আবার দিলীপ বিশ্বাসের জিঞ্জির মতিন রহমানের অন্ধ বিশ্বাস ছবির দুর্দান্ত অভিনেতার গুন এখনকার কয়েক জন নায়কের মাঝে খুজে পাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় কথা রাজ্জাক খুব ভালো করে জানতেন দর্শক কখন কি চায়, দর্শকের চাহিদা কি। তার বদনাম ছবিতে তিনি জাফর ইকবালের হিট গান হয় যদি বদনাম হোক আরো ছবিটি ব্যবসা সফল হয়।

তিনি খুব কৌশলী ছিলেন যে কখন কাকে দিয়ে কোন চরিত্রে অভিনয় করাতে হবে বা কাকে দিয়ে কোন কাজ করাতে হবে। যার ফলে তিনি চলচ্চিত্রের খারাপ সময়েও বাবা কেন চাকর ছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রের চেহারা পালটিয়ে দেন। ছবিটি দ্বিতীয় বার কলকাতায় চালিয়েও সাফল্য অর্জন করেন। রাজ্জাক ছোট থেকেই সম্রাটকে চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে আসেন।

রাজ্জাক তার দুই পুত্র বাপ্পারাজ এবং সম্রাটকে নিয়ে এক সঙ্গে অভিনয় করেছেন কোটি টাকার ফকির ছবিতে। দুই ছেলেকে নিয়ে অভিনয় করাটাকেই রাজ্জাক তার জীবনের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে মনে করেন। তিনি বলেন, আমার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। সবকিছুই আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তবে একটা কষ্ট আছে, সেটা হলো আমার বড়মেয়ে শম্পার অকাল মৃত্যু। ও বেঁচে থাকলে আমরা সম্পূর্ণ এবং পরিপূর্ণ পরিবার নিয়ে গর্ববোধ করতে পারতাম।

আবদুর রাজ্জাক থেকে যে মানুষটি একজন নায়করাজ রাজ্জাকে পরিনত হয়, তিনি হচ্ছে সেই দিনের কমলাপুরের ছোট্ট ঘর থেকে গুলশানের আলিশান বাড়ি খ্যাতি, সম্মান, অর্থ, যশ, দর্শকদের অকৃতিম ভালোবাসা এবং চলচ্চিত্রের প্রতিটি মানুষের শ্রদ্ধা স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার পিছনে অর্থাৎ আবদুল রাজ্জাক থেকে বর্তমান অবস্থানে আসার পিছনে যে সব মহত্ব ব্যক্তিদের অবদান রয়েছে তাদের সম্পর্কে বলেন, আমার আজকের এই অবস্থানের পিছনে যাদের অবদান রয়েছে তাদের মধ্য আছেন আবদুল জব্বার খান, জহির রায়হান, আজহারুল আনোয়ার, নজরুল ইসলাম, আবদুল লতিফ বাচ্চু, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুভাষ দত্ত, আজিজুর রহমান, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম এবং বন্ধু মজিবুর রহমান চৌধুরী মজনু। এদের সহযোগিতা না পেলে আমি আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পারতাম না। কৃতজ্ঞতা জানাই তাদেরকে যাদের ছবিতে আমি জাতীয় চলচ্চিত্র ও বাচসাস পুরস্কার পেয়েছি।

বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই প্রযোজক-পরিবেশক একেএম জাহাঙ্গীর খানকে যিনি আমাকে শরৎচন্দ্রের গল্প অবলম্বনে দুটি ছবি চন্দ্রনাথ ও শুভদাতে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।

বন্ধু পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম এই দুই ছবির বাইরেও আমাদের নিয়ে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নামে আরো একটি সাহিত্য নির্ভর ছবি নির্মান করেছেন। অর্থাৎ সবাই আমাকে নায়ক রাজ হতে সাহায্য করেছে। যাদের সাথে আমি কাজ করেছি তাদের ভালোবাসা আমাকে ঋনি করে রেখেছে। তাদের ঋন শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই।

নায়ক রাজ রাজ্জাক বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য চ্যানেল আই চলচ্চিত্র মেলা ২০০৯ তার পুরো পরিবারকে সম্মাননা প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এই চলচ্চিত্র মেলা ও সম্মাননা অনুষ্ঠানে তিনি স্বপরিবারে উপস্থিত হন। শুধু বাপ্পারাজ দেশের বাহিরে থাকার কারনে উপস্থিত হতে পারেনি। অনুষ্ঠানে তথ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী রাজ্জাক পরিবারের হাতে সম্মাননা তুলে দেন।

রাজ্জাকের অভিনিত পরিচালিত ছবি ১৮ টি। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হচ্ছেঃ- অনন্ত প্রেম, মৌ চোর, বদনাম, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির, মন দিয়েছি তোমাকে এবং উত্তর ফাল্গুনী। তার নির্মিত সর্বশেষ ছবি হচ্ছে আয়না কাহিনী।

রাজ্জাক বাংলা উর্দু মিলিয়ে এই পর্যন্ত প্রায় ৫০০ টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি শুধু নায়ক হিসাবে নয়। এক জন পরিচালক হিসাবেও সফল। চলচ্চিত্রের বাইরে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেছেন নায়করাজ রাজ্জাক। তার প্রযোজনা সংস্থার নাম রাজলক্ষী প্রোডাকশন। রাজ্জাক বাবা আকবর হোসেন ও মা মিরারুন্নেসার কনিষ্ঠ সন্তান। রাজ্জাকের দুই পুত্র বাপ্পারাজ এবং সম্রাট চলচ্চিত্র অভিনেতা।