ট্রেনের ইঞ্জিন খোলা ও লাগানোর কাজে মাদকাসক্ত শিশু

রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন দেশের বৃহত্তম রেল স্টেশন। এ স্টেশন থেকে প্রতিদিন ১১২টি ট্রেন বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। কিন্তু সবচেয়ে আশঙ্কার কারণ হচ্ছে, এসব ট্রেনের ইঞ্জিন খোলা ও লাগানোর কাজগুলো করছে স্টেশনের ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা।

এসব শিশুর অধিকাংশ নেশাসক্ত। নেশাসক্ত অবস্থায়ই এরা ভারি ও বিপজ্জনক যন্ত্রাংশের কাজ করে ভোর থেকে রাত ১২টা অবধি। কাজটি মূলত রেলওয়ের পয়েন্টম্যানদের। কিন্তু তারা কাজগুলো না করে যৎসামান্য এ রকম ‘ভয়ানক’ কাজটি চলছে বছরের পর বছর।

ঈদের সময় ট্রেনের সংখ্যা বাড়ে, ফলে এসব শিশুর ব্যস্ততাও বেড়ে যায়। যত বেশি ইঞ্জিন খোলা ও লাগানোর কাজ করা যায়, ততবেশি টাকা। এমন প্রতিযোগিতায় শিশুরা কোনোমতে ইঞ্জিনগুলো লাগানোর কাজ করছে। অথচ ইঞ্জিনের সঙ্গে বগিগুলো (ট্রুন) লাগাতে গিয়ে উনিশ থেকে বিশ হলেই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়তে পারে ট্রেনগুলো।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রেলপথমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন।

কমলাপুর স্টেশনে নেশাসক্ত শিশু প্রবেশ করতেই পারে না জানিয়ে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. হাবিবুর রহমান জানান, একটি ট্রেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইঞ্জিন থেকে ট্রেনটিকে আলাদা করা এবং পুনরায় ইঞ্জিনটি ট্রেনের সঙ্গে যথানিয়মে সংযুক্ত করা। এ কাজ কিছুতেই একজন শিশু করতে পারে না, সম্ভব নয়। এমন হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিশুদের দিয়ে ট্রেন প্রস্তুত করা মানেই ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্য দিয়ে ট্রেন চালানো- যা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।

এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, রেলওয়েতে কোনো পদেই শিশুদের নিয়োগ দেয়া হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্ব স্ব স্থানে কাজ করবেন, এটাই নিয়ম। স্টেশনে পয়েন্টম্যান রয়েছে, তারাই প্রতিটা ট্রেনের ইঞ্জিন খোলা ও লাগানোর কাজ করছেন। কমলাপুর রেলস্টেশনে কোনো কাজ শিশুরা করছে না এমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, ইঞ্জিন লাগানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অভিজ্ঞ কর্মীরাই এ কাজটি করছেন। কিন্তু মাহবুবুর রহমানের কথার সঙ্গে মিল পাওয়া গেল না খোদ তার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্যের।

কমলাপুর স্টেশন মাস্টার মো. কামরুজ্জামান জানান, স্টেশনে প্রতিদিন ১১২টি ট্রেন চলাচল করে, অর্থাৎ ১১২টি ট্রেনের ইঞ্জিন খোলা ও লাগানোর কাজ করতে হয় স্বল্পসংখ্যক পয়েন্টম্যান দ্বারা। ডিউটি ভাগ অনুযায়ী ৬ জনের মধ্যে মাত্র ২ পয়েন্টম্যান ৮ ঘণ্টা করে কাজ করেন। সবগুলো ট্রেনে কাজ করতে হলে দরকার ১২ থেকে ১৫ পয়েন্টম্যানের।

পয়েন্টম্যান মো. লোকমান হোসেন জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভয়ে কথা বলতে পারি না। এতবড় স্টেশনে মাত্র দু’জন করে পয়েন্টম্যান কাজ করছেন। বৃহস্পতিবার তিনিসহ আরেকজন পয়েন্টম্যান কাজ করছেন দুপুর থেকে। বললেন, নিজে অসুস্থ। স্টেশনে তাদের পদের লোকস্বল্পতা বহুদিনের। তাই বাধ্য হয়েই শিশুদের দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। একজন শিশুকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে দেয়া হয়। এসব শিশুর সংখ্যা ১৫।

পয়েন্টম্যান সৈয়দ অলিউর রহমান বলেন, তারা মাত্র দু’জন করে ঝড়-বৃষ্টিতে কাজ করতে হয়। এসব শিশু না থাকলে কিছুতেই কাজ সম্পন্ন করা যেত না। আমরা যে কাজ করছি না তা কিন্তু নয়, আমরা কাজ করে সামলাতে পারছি না বলেই নিজেদের পকেট থেকে টাকা দিয়ে এসব শিশুকে কাজে লাগানো হচ্ছে। লোকবল স্বল্পতা থাকায় নিয়মানুযায়ী এ কাজ মাস্টার রুলের কর্মচারী দিয়ে করার কথা, কিন্তু তা করা হচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে মাঠ পর্যায়ে ট্রেনে কাজ করা শুধু পয়েন্টম্যান নয় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজও নির্ধারিত দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন করছেন না। কিছু টাকা দিয়ে স্টেশনে থাকা ভবঘুর কিংবা মাদকাসক্তদের দিয়ে করানো হচ্ছে। অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই কর্মচারী ঠিকই সরকারি বেতন নিচ্ছেন। এসব অনিয়ম কাজে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

কমলাপুর স্টেশনে বেড়ানো ট্রেনের ইঞ্জিন খোলা ও লাগানোর কাজে নিয়োজিত শিশুরা বলছে, তারাও নিরুপায় হয়েই জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজগুলো করছে। এ কাজে যৎসামান্য টাকা পেলেও তাদের কাজ করতে হচ্ছে। কাজ না করলে বিশেষ করে রাতের বেলায় স্টেশনে থাকতে দেয়া হয় না তাদের। অনেক সময় মন না চাইলেও ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজ তাদের করতে হয়। অনেকে আবার চোখে-মুখে ঘুম নিয়ে নেশাসক্ত অবস্থায় কাজ করছে।

১৩ বছরের শিশু রনি হাসান জানায়, বেঁচে থাকার জন্যই সে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। তাদের কাজের কোনো সময় নেই, ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তাদের ইঞ্জিন খোলা ও লাগানোর কাজ করতে হয়। বাড়ি বরগুনা। বাবা রুবেল মিয়া দিনমজুর। রাজধানীতে তার থাকার জায়গা কমলাপুর রেলওয়ে ৮ নম্বর প্লাটফর্ম।

শিশু হেলাল জানায়, তারা তাদের (পয়েন্টম্যান) হয়ে কাজ করে দিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক শিশু জানায়, অনেক পয়েন্টম্যান মাসের পর মাস কাজে আসে না। তাদের হয়ে শিশুরাই কাজ করছে টাকার বিনিময়ে।প্রতিবেদন যুগান্তরের সৌজন্যে প্রকাশিত।