ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা বিকলাঙ্গ রোগীর মতো : আনিসুল হক

রাজধানী ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে বিকলাঙ্গ বা ক্যান্সার রোগীর সঙ্গে তুলনা করলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক করে তারপর তা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান তিনি। রবিবার (১৬ জুলাই) দুপুরে উত্তর সিটির নগর ভবনে ‘নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে আন্তঃ বিভাগীয় সমন্বয় সভা’ শীর্ষক এক সভায় মেয়র ওই তুলনা করেন। সভায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে সিটি করপোরেশনে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়।

সভার এ সিদ্ধান্তের পর ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে বিকলাঙ্গ বা ক্যান্সার রোগীর সঙ্গে তুলনা করে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের পর তা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান মেয়র আনিসুল হক।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ, জলাবদ্ধতা নিরসনের লিড এজেন্সি কে? ওয়াসার পক্ষে জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব নয়। এ কথা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই, তারা জনগণ থেকে অনেক দূরে। যারা জনগণের কাছে ডাইরেক্ট রেসপন্সিবল, যাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, আমার মতে লিড এজেন্সি হবে তারাই। আপনারা সবাই রাজি থাকলে লিড এজেন্সি হওয়া উচিৎ পৌর করপোরেশনের (সিটি করপোরেশন)।’ এসময় ওয়াসার এমডি হাততালি দিয়ে তা সমর্থন করন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও একমত হন।

মন্ত্রী উপস্থিত সবার উদ্দেশ্য এ সিদ্ধান্তের কথা জানালে মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘স্যার রোগী ভালো কইরা বাচ্চা দিয়ে দেন আমাকে। রোগীর ক্যান্সার- এগুলো দিয়ে লিড এজেন্সি কি করবে? আমার কোনও ঢাল নেই, তলোয়ার নেই।’ জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আগে রোগী গ্রহণ করেন, ভালো করার দায়িত্ব আমার।’

সভায় ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে উদ্দেশ করে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘১৯৯৬ সালে ট্রলারে করে বেড়াতে গেছি। কিন্তু এবার জিপে-গাড়িতে করে গেছি। সেই নিম্নাঞ্চলগুলো সব ভরাট হয়ে গেছে। এখন পানি যাবে কোথায়? আপনি খাল পরিষ্কার করেন। কিন্তু শুধু উপরের আবর্জনা পরিষ্কার করলে তো হবে না। নিচের মাটিও পরিষ্কার করতে হবে। আপনি সঠিক কাজটা করতে পারছেন না।’

খাল ও নদী উদ্ধারে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানিয়ে গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বার বার বলছেন নদীর গভীরতা বাড়াতে হবে। সিএস রেকর্ডে যদি নদী থাকে এখন থাকবে না কেন? অতি তাড়াতাড়ি প্রয়োজনে সেনাবাহিনী নিয়োগ করেন। ড্রেজিং করে অবৈধ সব স্থাপনা ভেঙে দেন। ‍দু’একটা ভেঙে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ রাজউক কর্মকর্তাদের সমালোচনা করে মন্ত্রী বলেন, ‘যে প্ল্যান পাস করে নিয়ে যাওয়া হয়, সে অনুযায়ী বাড়ি নির্মাণ হয় না। অথচ তা তদারকি করার জন্য আমাদের অথারাইজড অফিসার ও পরিদর্শক আছে। সেগুলো তাদের সামনেই হচ্ছে।’

অনুষ্ঠানে ডিএনসিসির ১১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আব্দুল মান্নান খাল দখলের জন্য ওয়াসাকে দায়ী করে বলেন, ‘কালভার্ট আছে, খাল নেই। আজ ‘ক’,‘খ’,‘ঘ’ খাল আছে, মাঝে ‘গ’ খাল নেই। ওয়াসার একজন উপদেষ্টা খালের ওপরে বাড়ি করেছেন। তাহলে খাল থাকবে কিভাবে?’

এসব অভিযোগের জবাবে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘আমরা ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান করেছি। ২০১২ সাল থেকে মন্ত্রণালয়ে বহু মিটিং করেছি। এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি। সারা পৃথিবীতে দেখেন কোথাও এমন নেই যে, শহরে বিশুদ্ধ পানি তৈরি করে যারা, তারাই আবার সে শহরের ড্রেনেজ সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট করে। শুধু ঢাকাই ব্যতিক্রম। একটি বিশেষ কারণে এই দায়িত্ব ওয়াসাকে দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ট্যাকনিক্যাল রং।’

জবাবে মেয়র বলেন, ‘ভুল হলেও এটা আপনাকে ঠিক করতে হবে। কারণ বাচ্চা তো আপনার কাছে।’ পরে ওয়াসা এমডি বলেন, ‘আমি তো সেই কারণেই বাচ্চাটা আপনাকে দিয়ে দিতে চাচ্ছি।’ এরপর মেয়র বলেন,‘বিকলাঙ্গ বাচ্চা দিয়ে লাভ কি?’

অনুষ্ঠানে ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা খালের অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে পাঠিয়েছি। খালের অবস্থান সিএস, আরএস জরিপে ঠিক আছে। কিন্তু সিটি জরিপে কমে গেছে। এখন তালিকা ধরে ধরে উচ্ছেদ করলেই খাল ফিরে আসবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগে থেকে থাকা খালের সঙ্গে আরও কিছু স্থানে জমি অধিগ্রহণ করে খাল খনন করা হয়েছিল। কিন্তু এগুলো অবৈধ দখলে চলে গেছে। কিছু অবৈধ দখল উচ্ছেদ করেছি। কিন্তু এরপর আর সম্ভব হয়নি। খালের সীমানায় ৫তলা বাড়ি হয়ে গেছে। রাজউক এর অনুমোদনও দিয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলে তারা কাগজপত্র নিয়ে আসে। তাদের কাগজ অনুযায়ী ওই এলাকায় খালের কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। বিদ্যমান যা পেয়েছি তা রক্ষণাবেক্ষণ করছি। আমরা প্রতিনিয়ত খাল পরিষ্কার করছি।’

অনুষ্ঠানে বুয়েটের অধ্যাপক মুজিবুল হক, নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব ও নজরুল ইসলাম তাদের মতামত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে ঢাকার খালের বর্তমান চিত্র নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখা গেছে, দুটি সেতু ব্লক হয়ে পড়েছে। মেয়র আনিসুল হক এ বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী সরেজমিনে পরিদর্শন করে সেগুলো ঠিক করে দেওয়ার ঘোষণা দেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ডিএনসিসির সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার শরিফ উদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শন করা ডিএনসিসি এলাকার খালের চিত্র প্রজেক্টরের মাধ্যমে তুলে ধরেন। তাতে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীতে ৪৩টি খাল রয়েছে। এর সবগুলোর মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ২৬টি খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ৮টি খালের নিয়ন্ত্রণ ঢাকা জেলা প্রশাসনের। ৯টি বক্স কালভার্ট ব্রিক সুয়্যারেজ লাইনের মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতিতে পানি নিষ্কাশন করে।

ইঞ্জিনিয়ার শরিফ উদ্দিন আহমেদ জানান, ডিএনসিসি এলাকায় ২৩টি খাল রয়েছে, যার সবগুলো বেদখল হয়ে গেছে। ওইসব খাল দিয়ে নদী পর্যন্ত পানি পৌঁছাতে পারছে না। এ কারণে রাজধানীতে অল্প বৃষ্টিতে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য একেএম রহমত উল্যাহ,রাজউক চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান, ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেসবাহুল ইসলাম প্রমুখ।