তুলসী পাতার রস ও অভাগা শিক্ষাব্যবস্থা

সাফাত জামিল শুভ : অনেক আগে থেকেই শুনে আসছি জাপানে নাকি ছোটবেলা থেকেই পেশাভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হয়।অর্থাৎ,শিশুর শিক্ষাজীবনের প্রথম কয়েক বছর তাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং তারপর ঠিক করা হয় যে তার জন্য কোন পেশা উপযোগী।সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের সুযোগ আর হয়নি। গতসপ্তাহে ইউটিউবে একটি ভিডিও দেখে আগ্রহী হয়ে উঠি জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। সেখানে একটি কথা আছে এরকম- “In Japanese schools, the students don’t get any Exams until they reach grade four (the age of 10) because the goal for the first 3 years of schools is not to judge the child’s knowledge or learning,but to establish good manners and to develop their character.”

আবার সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা বরাবরই র‍্যাঙ্কিংয়ে খুব ভালো করে এসেছে। সেখানকার এক শিক্ষকের কথা -“সিঙ্গাপুর যদি শিক্ষাব্যবস্থার একটি শক্তিশালী ভিত্তি দাঁড় করাতে না পারতো তাহলে আজ আমরা এই অবস্থায় আসতে পারতাম না। কোন কিছু যদি কাজ না করে, তাহলে আমরা সেটাতে কিছু পরিবর্তন আনার চিন্তা করি। প্রতি ৫ বছর বা ১০ বছর পর আমরা বলি না যে, আমাদের পুরনো নীতি ভুল ছিল এবং এখন পুরো ব্যবস্থায় বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে হবে।”

দুটি দেশের আকর্ষণীয় শিক্ষাব্যবস্থার কথা চিন্তা করে যখন স্বার্থপরের মত নিজের দেশের কথা ভাবি, তখন কম্পিউটার তথ্য দেয়- “বিশ্বের নামকরা দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই।”

স্পষ্ট মনে পড়ে, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ৫-৬ টা কবিতা মুখস্ত করতে হতো।সেটাই আবার দাড়ি-কমাসহ পরীক্ষার হলে লেখে আসতাম। কারন দাড়ি কমা ভুল হলে নম্বর কমে যাবে। অগণিত ছোট-বড় প্রশ্ন,গল্পের লাইন,কবিতার লাইন মুখস্ত করে লিখে আসতে হতো। কিন্তু এসবের মানে কি?

ব্রেনের উপর প্রেশার আর অযথা সময় নষ্ট করা ছাড়া এভাবে কি আমরা কিছু শিখেছি??স্কুল-কলেজ লেভেলে আমাদের যেটা করানো হয় সেটা কি অনেকটা তুলসী পাতার রস খাওয়ানোর মত নয়?

তাও আর হজম হয় না, হয় বদহজম। তারপর পরীক্ষার হলে গিয়ে স্রেফ উগড়ে দিয়ে আসি।

বোধ করি কাজী নজরুল ইসলাম,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,প্রমথ চৌধুরী,সুফিয়া কামাল,শামসুর রাহমান এতসব কবিতা,ছোটগল্প,প্রবন্ধ আমাদের মুখস্ত করানোর জন্য লিখেননি।তারা কোন সময়ই এইটা ভাবেন নি যে তাদের লেখাগুলো বই আকারে ছাপা হবে এবং আমাদের মত শিক্ষার্থীদের টিয়া পাখির মত মুখস্ত করতে হবে। তাদের মনে চেয়েছিল,ভাল লেগেছিল বলেই তারা লিখেছিলেন।আমাদের আনন্দ দিতে,সচেতন করতে,আমাদের মুখস্ত করানোর জন্য না।

৯ম-১০ম শ্রেনীর বাংলা ১ম পত্র বইতে ”প্রমথ চৌধুরীর” একটি প্রবন্ধ ছিল ”বই পড়া” নামক। সেখানে তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি উল্লেখ করে বলেছিলেন,”আমাদের বিদ্যালয়ের মাস্টার মসাইরা গাদা গাদা নোট তৈরি করেন আর তা,আমাদের ছাত্ররা মুখস্ত করে, এবং পরীক্ষার হলে তা উদগিরন(বমি) করে আসে।ব্যস শেষ শিক্ষার কর্ম সাধন।” যদি ‘প্রমথ চৌধুরী ঘূণাক্ষরেও টের পেতেন যে তার এই ‘বই পড়া’ প্রবন্ধ নিয়েও বিদ্যালয়ের মাস্টার মসাইরা আজকাল সৃজনশীল প্রশ্নের লেবাসে নিতুন নতুন নোট বানান এবং তা ছাত্রদেরকে মুখস্ত করান, তাহলে তিনি যে কি করতেন শুধু তিনিই জানেন।কিন্তু আমার-ও খুব জানতে ইচ্ছা করে।

বাচ্চারা paragraph,composition,letter,এসব মুখস্ত করে, কিন্তু অতি হাস্যকর বিষয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বুঝতেই দেয়না, এসব Composition, Paragraph বাইরের দেশের একটা মানুষের ১-২ মিনিট এর ভাষা বা বক্তব্য ছাড়া কিছুই না। কেননা ইংরেজী একটা ভাষা মাত্র। মৌলিক কোন জ্ঞানকান্ড না। আর আমরা সেটাই মুখস্ত করার জন্য ক্লাস এর পর ক্লাস করি,কোচিং করি,এখানে দৌড়াই সেখানে দৌড়াই শুধুমাত্র মার্কস পাওয়ার জন্যে।কিন্তু শেখার জন্যে না।

আমাদের দেশে যে বয়সে ছেলেরা video games খেলে অন্য দেশে সেই বয়সে ছেলেরা গেম বানায়,সফটয়্যার বানায়,কোনো প্রোগ্রামে এ ভুল থাকলে তা সংশোধন করতে পারে।তারা কি লেখা পড়া করে না? তাহলে আমরা কেন পারি না?

৭ অক্টোবর, ২০১৬ দৈনিক ইত্তেফাকে ড. জাফর ইকবাল ‘আমার ভাঙা রেকর্ড’ কলামে দেখিয়েছেন কোনো রকম লেখাপড়া না করেও বর্তমান পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থায় ৬০-৭০ শতাংশ নম্বর পাওয়া সম্ভব। আর কেউ যদি একটু খাটাখাটুনি করে ১০-২০ নম্বর পায়, তাহলে গোল্ডেন এ+ পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। তার মানে হলো আমাদের সময়ের সনাতন পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার মানদন্ডের বিবেচনায় এখন যারা জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে, তারা মূলত ফেল করা শিক্ষার্থীর কাতারেই পড়ে। অর্থাৎ এখনকার ৮০ শতাংশ নম্বর পাওয়া ছাত্র এক হিসেবে অকৃতকার্য ছাত্রই বটে।”

বাংলাদেশে মোটামুটি চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর স্তর (বিশ্ববিদ্যালয়)। এই হলো আমাদের শিক্ষার প্রচলিত কাঠামো। এই চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে আছে আরো নানা উপস্তর (মক্তব, গ্রামভিত্তিক শিক্ষা, কওমি শিক্ষা, তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যম ইত্যাদি)। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর আগের চেয়ে আধুনিক হয়েছে এবং পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়েছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, এমনটিই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন। কিন্তু ভেতরের খবর খুবই হতাশাব্যঞ্জক। আমাদের অবুঝ শৈশবে আমরা যে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষাকে যদি বর্তমান দৃষ্টিকোণে ত্রুটিপূর্ণ বলে ধরা হয়, তাহলে এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অসঙ্গত নয় যে, সেই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা নিয়েই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক শিক্ষার সমস্ত-সুযোগ পেয়েও, পরীক্ষায় সোনালি প্রতীক (গোল্ডেন এ+) পেয়েও কেন এ যুগের শিক্ষার্থীরা দুই জনের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না তা পুরো জাতিকে চিন্তিত করে তুলেছে। তাহলে কি প্রশ্ন উঠতে পারে না কোন শিক্ষা ভালো ছিল? আগের সনাতন শিক্ষা পদ্ধতি নাকি আধুনিক সৃজনশীল পদ্ধতি?

বাংলাদেশের কোনো স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের চিত্র দেখলে যে কোনো বিবেকবান মানুষই আঁতকে উঠবেন। এ দেশের কোনো স্কুলে-কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হরে ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। একজন এমএলএসএস বা নৈশ প্রহরী নিয়োগের ক্ষেত্রে ২ থেকে ৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কোনো শিক্ষক যখন শিক্ষাদানের মতো পবিত্র পেশায় ঢোকার আগেই মোটা অংকের টাকা ঘুষ দেন তখন তিনি কিভাবে শিক্ষার্থীকে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দিবেন? দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন বের হয় যার শিরোনাম- ‘টাকার কাছে হার মানছে মেধা।’ যারা সেই প্রতিবেদন পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়।

সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি’ তরুণদের অপছন্দের কারণ। এদেশের রাজনীতিবিদদের প্রতিহিংসা পরায়নতা, স্বার্থবাদীতা ইত্যাদি সহজেই দৃশ্যমান। অন্যান্য সবকিছুর মত শিক্ষাব্যবস্থার মত একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে বারবার পরিমার্জিত,সংশোধন এবং আগের প্রচলিত পদ্ধতি ভুল ছিল এমনটি বলে তরুণদের বারবার বিভ্রান্ত করা হয়।

বিশ্বের উন্নত দেশে অনেক কাজের ক্ষেত্র আছে। তারা সেখানে ইচ্ছা করলেই ঘণ্টা ভিত্তিক কাজ করতে পারে, অলস বসে থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে কাজের কোন ক্ষেত্র না থাকায় তরুণরা কোন বাস্তবমুখী কাজ করতে পারে না। আমাদের রাজনীতিবিদদের কিন্তু সে দিকে কোন খেয়াল নেই।বর্তমানকালে প্রশ্নফাঁস,ভর্তিবাণিজ্য প্রভৃতি শিরোনামের খবর হরহামেশাই চোখে পড়ে, যা স্বাভাবিক ঘটনাতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জনমনে সীমাহীন অসন্তোষ। এমন কোনো দিন নেই যে পত্র-পত্রিকায় ও টেলিভিশনের টক-শোগুলোতে আমাদের শিক্ষার অব্যবস্থাপনা কিংবা শিক্ষার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা না হচ্ছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা-বিষয়ক নীতি-নির্ধারকরা তাতে কর্ণপাত করছে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একটি অসুস্থ ধারার বিকলাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থায় ভর করে পুরো জাতি আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বিষয়ে এখনই পরিকল্পনা নির্দিষ্ট করা দরকার।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়