থাইল্যান্ডে বিচার হলেও বাংলাদেশে হয়নি

‘এক মুঠ ভাত আর এক কাপ পানি দিত। আরও পানি চাইলে রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করত। কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁর মাথায় গুলি করে সমুদ্রে ফেলে দিত।’

দুই বছর আগে থাইল্যান্ডের উপকূলীয় গহিন অরণ্যে আটক অবস্থার এই ভয়াবহ বিবরণ দিচ্ছিলেন সেখান থেকে ফিরে আসা সুনামগঞ্জের জালাল। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যখন তাঁকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনা হয়, তখন হাড়জিরজিরে শরীর দেখে তাঁকে চেনার উপায় ছিল না।

মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্র দেশের বিভিন্ন জেলার শত শত মানুষকে পাচার করেছে। তাঁদের জাহাজে তুলে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী দুর্গম অঞ্চলে নিয়ে চালানো হয়েছে ভয়াবহ নির্যাতন। এভাবে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করা হতো।

দুই বছর আগে এই চক্রের কর্মকাণ্ড ফাঁস হলে তোলপাড় শুরু হয়। পাচারে জড়িত চক্রের বিরুদ্ধে থাইল্যান্ডের একটি আদালত গত বুধবার দেশটির সেনাবাহিনীর এক জেনারেলসহ অর্ধশতাধিক আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেন। অথচ বাংলাদেশের যাঁরা মানব পাচারে জড়িত ছিলেন, এ দেশে তাঁদের কেউ এখনো বিচারের মুখোমুখি হননি। ঢাকার আদালতে দায়ের করা এ-সংক্রান্ত তিনটি মামলার ব্যাপারে খোঁজ করে দেখা গেছে, দুটির তদন্ত শেষ হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার আদালতের কাছে আবেদন করে তদন্তের সময়সীমা বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। একটির তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও সেটির বিচার শুরু হয়নি।

ঢাকা ছাড়াও কক্সবাজারে সে সময় আরও কিছু মামলা দায়ের করা হয়। জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, একই ঘটনায় থাইল্যান্ডে বিচার হলেও বাংলাদেশে তদন্ত ও বিচার শুরু না হওয়া খুবই দুঃখজনক ঘটনা।

২০১৫ সালের ১ মে থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশের গহিন অরণ্যে শরণার্থীদের বেশ কিছু নির্যাতনশিবির ও ৩৬ জন শরণার্থীর গণকবর আবিষ্কৃত হয়। প্রায় একই সময়ে পার্শ্ববর্তী মালয়েশিয়ায়ও অভিবাসীদের গণকবর আবিষ্কৃত হয়। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে পাচারকারী ও তাঁদের সহযোগী দালালেরা গভীর সমুদ্রে লক্কড়ঝক্কড় নৌকায় বহু অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ফেলে রেখে পালিয়ে যান। তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক।

থমকে আছে তদন্ত ও বিচার

থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় মানব পাচারকারীদের হাতে নির্যাতনের শিকার ১৭৫ জনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় দুই বছর আগে। তাঁরা রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় পৃথক তিনটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের জুন ও জুলাই মাসে করা এসব মামলায় দেশের বিভিন্ন জেলার মানব পাচারকারী চক্রের ৫৩ জন সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়। এসব মামলার তদন্তভার পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ছয়জন।

বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা একটি মামলার বাদী আল আমিন নরসিংদীর মহিশাশুরি ইউনিয়নের বালুচর গ্রামের বাসিন্দা। এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ৫ মার্চ মনির নামে এক স্থানীয় দালালের মাধ্যমে এলাকার কয়েকজন তরুণ কক্সবাজারের লালদীঘির পাড়ে যান। সেখানে অন্য দালালেরা তাঁদের ১৬০ জনকে যাত্রীবাহী একটি নৌকায় তুলে দেন। নৌকাটি তাঁদের নিয়ে সমুদ্রপথে মিয়ানমার সীমান্তে পৌঁছায়। সেখানে তাঁদের ওঠানো হয় বড় একটি জাহাজে। সেই জাহাজে ছিলেন ৪০০ যাত্রী। জাহাজটি থাইল্যান্ড জলসীমায় পৌঁছায়। সেখানে জাহাজে তাঁদের রাখা হয় ৩২ দিন। এই সময়ের মধ্যে জাহাজের প্রধান দালাল আবদুর রহমান পালিয়ে যান। পরে পুলিশ তাঁদের আটক করে।

দূতাবাসের সহায়তায় আরও ৬৪ জন বাংলাদেশি নাগরিকসহ ২০১৫ সালের ১৮ জুন আল আমিন ঢাকার বিমানবন্দরে নামেন। এই মামলায় পুলিশ আশরাফ ফকির ও জাহেদুল ইসলাম নামের দুই আসামিকে ২০১৫ সালের ৮ আগস্ট গ্রেপ্তার করে। প্রথমে তদন্ত করেন সিআইডির পরিদর্শক আবদুল মান্নাফ ছাকাতী। পরে সিআইডির আরেক পরিদর্শক ফাতেমা বেগম তদন্তভার পান। গত বছরের ১৭ জুলাই তিনি তদন্ত শুরু করেন। তদন্ত শেষ হয়নি।

আট দফায় আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছে, অপরাধের শিকার ব্যক্তি ও অপরাধীরা দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় তদন্তে বাড়তি সময় লাগছে।

বিমানবন্দর থানায় অপর মামলার বাদী মাহমুদ নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা। এলাকার দালালের মাধ্যমে হাতবদল হয়ে তিনিও কক্সবাজার উপকূল দিয়ে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ডে পৌঁছান। এরপর জিম্মি করে তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আদায় করেছে পাচারকারী চক্র।

এই মামলায় কক্সবাজারের জাহেদুল ইসলাম ও আল আমিনকে ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই ও ২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

কেন এত দিনেও তদন্ত শেষ হচ্ছে না, জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান গতকাল বলেন, অনেক ভিকটিম। তাঁদের অনেকের সঙ্গে এখনো কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাঁদের সাক্ষ্য নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের প্রধান নেতাদের এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। অনেকে বিদেশে আছেন।

সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) রওশন আরা বেগম বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের যেসব মামলা তদন্তাধীন, সেগুলোর বিষয়ে তিনি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন

বিমানবন্দর থানার তৃতীয় মামলার বাদী ইয়াসিনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার জেলার কল্যানদী গ্রামে। পাচারকারীদের খপ্পর থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয় ইন্দোনেশিয়ার সীমান্তে।

মামলাটি তদন্ত করে সিআইডির এসআই এ এইচ এম রাশেদ ফজল গত বছরের ২৬ অক্টোবর এমরান, শফিউল আলম, আবদুল্লাহ ভুট্টসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। পলাতক আছেন নারায়ণগঞ্জের আবদুল হামিদ, চট্টগ্রামের ইসমাইল, কক্সবাজারের মোহাম্মদ আলী ও খাইরুল হক। বর্তমানে ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটি অভিযোগ গঠনের শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। মানব পাচার আইন বলছে, অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সংঘবদ্ধ মানব পাচারের এসব মামলায় রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল হয় না। অন্য হাজার হাজার মামলার তদন্ত যেভাবে থমকে থাকে, এসব মামলারও সেই একই পরিণতি। আমাদের দেশের বেশির ভাগ সংঘবদ্ধ অপরাধ ক্ষমতাসম্পন্ন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের সহায়তা ছাড়া যেহেতু হয় না, সেহেতু এ ধরনের অপরাধের তদন্ত-বিচারও ঠিকমতো হয় না।