থানায় কিশোরীর আকুতি ‘ও স্যার, আমাকে বাঁচান’

থানায় ভিড়টা তখনও জমাট বাঁধেনি। ডিউটি অফিসারের টেবিলের সামনে সাকুল্যে দু’জন লোক বসে। তাঁরা এসেছেন অভিযোগ জানাতে। পুলিশ আধিকারিক তাঁদের সঙ্গেই কথা বলছিলেন। সোমবার সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ হাঁফাতে হাঁফাতে কোতোয়ালি থানার ওই ডিউটি অফিসারের কাছে এসে বছর চোদ্দোর এক নাবালিকা বলে, ‘ও স্যার, আমাকে বাঁচান। জোর করে বাবা-মা আমার বিয়ে দিচ্ছে। আমি পড়তে চাই।’

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁফাচ্ছে মেয়েটি। ডিউটি অফিসার তাকে বসতে বলেন। বিষয়টি জানানো হয় আইসি সুব্রত সরকারকে। সব শুনে তিনি খবর দেন মহিলা থানার আইসি রানুমিতা রায়কে। তিনি এসে কিশোরীকে নিয়ে যান মহিলা থানায়। ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয় ওই কিশোরীর বাবা-মাকেও। আইসি তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, সত্যিই তাঁরা মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। আগামী সোমবার তার বিয়ের কথা ছিল। মহিলা থানা থেকে ওই কিশোরীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিশু কল্যাণ দফতরে। তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয়, ১৮ বছরের আগে তাঁরা মেয়ের বিয়ে দেবেন না।

পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা ওই কিশোরী শক্তিনগর গার্লস হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। তার বিয়ের ঠিক হয়েছিল হাঁসখালিতে। ওই কিশোরীর বাবা-মায়ের দাবি, মেয়ে প্রথমে বিয়েতে রাজি ছিল। কিন্তু দিন তিনেক পর থেকে সে আপত্তি জানাতে থাকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিয়ে ভাঙা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কিশোরীর মায়ের কথায়, ‘আমার চার মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এই মেয়ের জন্যও ভাল পাত্র পেয়েছিলাম। পণও লাগছিল না। তাই বিয়েতে আমরা রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু মেয়ে যে বিয়ে করবে না বলে থানায় আসতে পারে, এটা ভাবতেই পারিনি। তবে ও যখন চাইছে না তখন ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আর বিয়ে দেব না।’ এ দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশের কাকিমার বাড়ি যাওয়ার নাম করে মেয়েটি সটান থানায় চলে আসে। সব শুনে মোবাইলের ও প্রান্ত থেকে হতাশ গলায় পাত্র বলেন, ‘বলেন কী! তাহলে বিয়েটা হবে না?’ ডিস্ট্রিক্ট চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারপার্সন রিনা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘মেয়েটি বাড়ি যেতে চায়নি। ওর পরিবারও বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়নি। সেই কারণেই আপাতত আমরা ওকে হোমে রেখেছি।’

শক্তিনগর গার্লস হাই স্কুলের টিআইসি শম্পা দে সরকার জানান, মাস দুয়েক আগে তাঁরাও স্বয়ংসিদ্ধা কমিটি গঠন করেছেন। পরীক্ষা মিটলেই তাঁরা সবাইকে নিয়ে নাবালিকার বিয়ে রুখতে জোর প্রচার চালাবেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার স্কুলগুলিতে স্বয়ংসিদ্ধা কমিটি তৈরির পরে বেশ কয়েকটি নাবালিকার বিয়ে রুখে দেওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি তেহট্টের নাজিরপুর বালিকা বিদ্যালয়ের স্বয়ংসিদ্ধা কমিটি দেড় মাসে পাঁচ নাবালিকার বিয়ে আটকেছে। স্বয়ংসিদ্ধা কমিটি আরও তৎপর হলে নাবালিকার বিয়ে দেওয়ার সাহস পাবে না কেউ।-আনন্দ বাজার