ধর্ষণের বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মুক্তিযোদ্ধাকন্যার চিঠি

পাওনা টাকা তুলে দেওয়ার কথা বলে কৌশলে ধর্ষণ, অতঃপর ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার কাছে বিচার চাইতে গিয়ে আবার ধর্ষণের অভিযোগ করছেন গাজীপুরের এক মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে। এই ঘটনায় মামলা করে হুমকির মুখে পড়েছেন ওই তরুণী।

স্থানীয় থানা পুলিশ আর প্রভাবশালীদের দাপটে ভুক্তভোগীর পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন দাবি করে গত ৪ মে ২০১৭ ইং তারিখে রাজধানীর ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে। এঘটনায় মামলা দায়েরের পর পুলিশ প্রধান আসামী মৃদুল ও তার সহযোগী রনিকে গ্রেপ্তার করলেও বাকিদের বিরুদ্ধে এখনো কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।

মামলার অপর আসামিরাও প্রভাবশালী হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ওই ভুক্তভোগী তরুণী। পুলিশ যে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছিল তারাও জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো ওই তরুণীকে হত্যা ও গুম করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন তিনি।

মামলার তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও সহযোগিতা না করে মামলা তুলে নিতে ভয় ভীতি দেখিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই তরুণী।

এমতাবস্থায় আইনি সহায়তা ও সাক্ষাত চেয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে একটি চিঠি দেন ওই তরুণী। গত ১ আগস্ট ২০১৭ ইং তারিখে চিঠিটি প্রধানমন্ত্রীর তেজগাঁও কার্যালয়ে পৌঁছে।

প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত চিঠিতে ভুক্তভোগী তরুণী জানান, গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকার বাসিন্দা আরেফিন খান মৃদুল ও রনি তার (ধর্ষিতার) পাওনা টাকা উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে গত ২৫ নভেম্বর কৌশলে মৃদুলের বাসায় নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করে। এতে ওই তরুণী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। বিষয়টি তিনি মৃদুলকে জানান এবং বিয়ের জন্য চাপ দেন। কিন্তু মৃদুল তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগী তরুণীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন।

পরে ওই তরুণী গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মৃদুলের রাজনৈতিক বড় ভাই ছাত্রলীগের সাবেক সহ সম্পাদক রকিব সরকারের নিকট বিচার চাইতে যান। সেখানে গেলে রকিব সরকারের লোকজন ভুক্তভোগী ওই তরুণীকে একটি মাইক্রোতে তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে রেখে তিনদিন পালাক্রমে ধর্ষণ করে।

পরে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে রাখে এবং তার পেটের বাচ্চাটাও নষ্ট করে দেওয়া হয়। এর তিনদিন পর তরুণীকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য হুমকি দিয়ে যায় রকিব সরকারের লোকজন।

এ ঘটনায় পরদিন (২৪ ফেব্রুয়ারি) ওই তরুণী জয়দেবপুর থানায় মামলা করতে গেলে জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম মামলা না নিয়ে থানা থেকে বের করে দেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করেন ওই তরুণী। এছাড়াও দুর্বৃত্তরা ওই তরুণীকে তার বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি।

ঘটনার ২ মাস পর গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদের নির্দেশে বাধ্য হয়ে মামলা নেন জয়দেবপুর থানার ওসি। মামলায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রকিব সরকার সহ আরেফিন খান মৃদুল, রনি, নাজমুল, আলমগীর, পলিন, রবিন ও দিপুকে আসামি করা হয়।

চিঠিতে ওই তরুণী উল্লেখ করেন, মামলার পর থেকে জয়দেবপুর থানার ওসি ও তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক আবুল কাশেম মামলার বিবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাকে মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করে আসছেন। মামলা তুলে না নিলে ভুক্তভোগী তরুণী এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দেয়ার হুমকি দেয় আসামিরা।

আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরাফেরা করছে এমনকি ওই তরুণীকে আদালতে যেতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে চিঠিতে।

চিঠির শেষ দিকে ওই তরুণী প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লিখেন, ‘প্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দুঃখের সহিত জানাচ্ছি যে, আপনার দেওয়া পুরস্কারের বাড়িতে (মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার দেওয়া বাড়ি) এখন উক্ত বিবাদীগণের ভয়ে বসবাস করতে পারতেছি না, কারণ বিবাদীগণ রাতের বেলা যে কোন সময় আমাদের প্রাণনাশ করতে পারে। এমতাবস্তায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমার অনুরোধ, দয়া করে উক্ত বিবাদীগণকে আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি।’

ভুক্তভোগী তরুণীটি বলেন, ‘ঘটনার কয়েকমাস পর পুলিশের উদাসীন আচরণের জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি, যা তদন্তনাধীন। নিরাপত্তা চেয়ে র‌্যাব-১ বরাবরও অভিযোগও দাখিল করেছি। মানবাধিকার কমিশনের কাছেও সাক্ষাৎ করে আইনি সহায়তার সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েও তার কোন প্রতিউত্তর পাইনি।’

‘ব্লাস্টের কাছেও আইনি সহায়তা চেয়েছিলাম। সেই মোতাবেক একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দিয়েছিল মামলা পরিচালনার জন্য। কিন্তু ওই আইনজীবী আসামিদের ভয়ে মামলাটি নিয়ে কোর্ট পর্যন্ত আর যাননি। অপরাগতা প্রকাশ করে তিনিও বিদায় নেন।’

তরুণীটির এই মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিনুল ইসলাম জানান, ‘ধর্ষণের মামলার বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা ভাল বলতে পারবেন। তদন্ত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন।’

আর মামলা উঠিয়ে নেওয়ার হুমকি প্রসঙ্গে ওসি বলেন, ‘পুলিশ কীভাবে হুমকি দিচ্ছে ? কাগজ-কলমে, মুখে, মোবাইলে নকি ফিজিক্যালি হুমকি দেওয়া হচ্ছে? মামলা তার নিজস্ব গতিতেই চলছে, তদন্ত কর্মকর্তা এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে পারবেন।’

এ ব্যপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক আবুল কাশেম বলেন, ‘এ মামলা নিয়ে আমি অনেক বিপদে আছি। মামলার বাদী আমার সাথে কোন যোগাযোগ করছেন না। তারপরও আমি মামলাটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। দুই জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছি। বাকিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।’

তদন্ত কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘মামলার বাদী আমার বিরুদ্ধে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে অভিযোগ দিয়েছিল। সেটি তদন্ত করা হয়েছে। বিবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলা তুলে নিতে আমি কোনরকম চাপ প্রয়োগ করিনি তাকে। ওই তরুণী পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছেন সেটি সঠিক নয়।’