‘নাড়ি না কেটেই বাচ্চা নিয়ে দৌড়েছি, কী যে যন্ত্রণা’

ছয় সন্তানের মা হামিদা (৩০)। সুন্দর এ পৃথিবীর আলো দেখতে তাঁর গর্ভে অপেক্ষা করছে সপ্তম সন্তান। মোটামুটি ভালোই চলছিল গর্ভকালীন জীবন। কিন্তু সময় যে এভাবে বদলে যাবে তা হয়তো কল্পনাও করেননি হামিদা। ভাবতেও পারেননি চোখ খুলে পৃথিবীর এক কুশ্রী রূপ দেখার অভিজ্ঞতা হবে তাঁর সন্তানের।

যেকোনো সময় জন্ম নিতে পারে হামিদার সন্তান। কিন্তু হঠাৎ করেই জ্বলে উঠল তাঁর গ্রাম। নির্বিচারে মানুষ মারা শুরু করল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বাদ পড়ল না নারী-শিশু-বৃদ্ধ কেউ। অন্তঃসত্ত্বা হামিদা ঘরে শুয়েই শুনতে পাচ্ছিলেন গোলা-গুলির শব্দ আর চিৎকার। সেদিন ছিল সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ।

সেনাবাহিনীর বন্দুকের হাত থেকে বাঁচতে হলে পালাতেই হবে। তাই অসুস্থ শরীর নিয়ে হামিদা পাড়ি দিলেন কাছের এক জঙ্গলের দিকে। সঙ্গে স্বামী ও ছয় সন্তান। পেছনে রাখাইন রাজ্যের মুংডোর কুয়াচং গ্রামে ফেলে আসলেন হাজারো স্মৃতি।

সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো সে দিনগুলোর কথা বলার সময় হামিদার মুখে অনুভূতির লেশমাত্র ছিল না। স্থির চোখে তিনি বলেন, ‘সেদিন হানাদাররা আমাদের গ্রামে হামলা চালাল। তারা আমাদের দিকে রকেট লঞ্চার দিয়ে বোমা ছুড়ছিল। এমনকি পালানো অবস্থায়ও আমাদের গুলি করে মারা হচ্ছিল। পুরো গ্রামটা তারা জ্বালিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল।’

গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর প্রায় দুদিন জঙ্গলে ছিল হামিদার পরিবার। এ সময় হঠাৎ তাঁর প্রসব বেদনা উঠল। পরিস্থিতি চিন্তা করে শিউরে উঠলেন হামিদা। জঙ্গলের মধ্যে চিকিৎসক তো দূরের কথা, সন্তান প্রসবের যন্ত্রণার সময় হাত ধরে রেখে বুকে সাহস জোগানোর মতোও কেউ নেই। এমনকি ছিল না এক টুকরা ছেঁড়া কাপড়ও।

সেই পরিস্থিতির মধ্যেই যন্ত্রণার সঙ্গে তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর সন্তান জন্ম দিলেন হামিদা। এমন সময়ই কাছেই শুনতে পেলেন সেনাবাহিনীর গুলির শব্দ ও হট্টগোল। যেকোনো সময়ই এসে পড়তে পারে তাদের কাছে। তাহলে মৃত্যু নিশ্চিত।

এদিকে প্রসবের পর তখনো সন্তানের নাড়ি কাটা হয়নি। সে অবস্থায় আবার দৌড়াতে শুরু করলেন হামিদা। কোলে সদ্যজাত সন্তান আর সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা ও ক্লান্তি। প্রাণ বাঁচাতে আর কিছুই করার ছিল না বলে জানান হামিদা।

হামিদা বলেন, ‘কী করতাম সে সময়? তারা আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। সৈন্যরা ধরতে পারলে আমাকে ও আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলত। অনেক যন্ত্রণা হচ্ছিল। অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না আমার।’

নবজাতককে কোলে নিয়ে কতক্ষণ দৌড়েছিলেন মনে করতে পারেন না হামিদা। তিনি জানান, একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটু জিরিয়ে নিতে বসেন তাঁরা। তখন নজরে এলো সন্তানের সঙ্গে তাঁর নাড়ি তখনো যুক্ত রয়েছে। তাঁর স্বামী তখন এক টুকরা বাঁশের ছিলকা কেটে আনেন। বাঁশ ছিলকা দিয়ে কাটা হলো নাড়ি।

এরপর আরো তিনদিন আশ্রয়ের উদ্দেশে পালিয়ে বেড়িয়েছে হামিদার পরিবার। নেই কোনো আশ্রয়, কোনো খাবার। শুধু পানি খেয়েই তাঁরা কাটিয়েছেন এ কয়দিন। এরই মধ্যে নবজাতকের দেওয়া হয়েছে একটি নাম। হোসেন সাহেব।

হামিদারা শুনেছে, বাংলাদেশে গেলে সেনাবাহিনীর বন্দুকের গুলি থেকে বাঁচতে পারবেন তাঁরা। তাই সেদিকেই রওনা দিলেন আবার। আরো দুদিনের হাঁটা পথ। দুদিন পর পৌঁছালেন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদীর তীরে।

হামিদাদের করুণ অবস্থা থেকে তাদের নদী পার করে দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এক বাঙালি মাঝি। নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যেটুকু পারেন খাবার তুলে দেন ক্ষুধার্ত এই পরিবারটির মুখে। তারপর তাদের নিয়ে যান কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্তের কাছের একটি শরণার্থী শিবিরে।

সীমান্তের কাছের ওই শরণার্থী শিবিরে ৫০ হাজার রোহিঙ্গার বাস। সেখানেই বাঁশ আর ত্রিপল দিলে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানালেন হামিদার স্বামী। তারপর সেই মাঝির দেওয়া কম্বল আর হাড়ি-পাতিল দিয়ে শুরু হলো তাদের অনিশ্চিত এক জীবন।

হামিদা বলেন, ‘আমরা এখানে থাকতে চাই না। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। কিন্তু কী করব। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি আমরা।’ কোলে ১৫ দিনের হোসেন সাহেব। অপুষ্টিতে-ক্ষুধায় শিশুটির কান্নার শক্তিও ছিল না। নবজাতকের দিকে তাকিয়ে হামিদা বলেন, ‘তার ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু আমার বুকে তো দুধ নেই।’

এদিকে ক্ষুধায় হামিদার অন্য শিশুরাও কাঁদছিল। তাদের জন্য খাবার আনতে ত্রাণ আনতে গেছেন হামিদার স্বামী। কিন্তু হামিদা জানে, নয়জনের সংসারে সে খাবার কিছুই না। এতে তাঁর সন্তানদের ক্ষুধা মিটবে না। তাঁরা আবার কাঁদতে থাকবে। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। এভাবেই চলতে থাকবে জীবন। এ অনিশ্চয়তা কতদিনের আর সবার মতো তা জানেন না হামিদাও।