নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী, বিমানবন্দরে স্বাগত-প্রতিবাদ মিছিল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেল চারটায় জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সরকারি সফর হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন বিমানবন্দরে যান।

তবে যাদের যাওয়ার কথা না তারাও গিয়েছিলেন নিউইয়র্কের এই বিমানবন্দরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে অন্তত ২ হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিত থাকার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. সিদ্দিকুর রহমান। প্রস্তুতি অনুযায়ী নানা রকম ব্যানার ফেস্টুন, স্লোগান, হলুদ রংয়ের গেঞ্জি পরে সেখানে কয়েকশ’ মানুষ উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে।

৪ নম্বর টার্মিনালের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে স্বাগত জানিয়ে নানা স্লোগানে মুখর রাখেন আগত নেতাকর্মীরা।

মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করাটাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়ার মূল উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন এখানকার আওয়ামী লীগ নেতারা।

তাদের মতে, এবার উনি শুধু যে বাংলাদেশকে জাতিসংঘে নেতৃত্ব দিতে আসছেন, এমনটা নয়, এবার তিনি রোহিঙ্গাদেরও নেতৃত্ব দিতে আসছেন।

টার্মিনালের সামনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা স্লোগান দিলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের সরিয়ে দেয় নিউইয়র্ক সিটির পুলিশ।

বিমানবন্দরে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের এক নেতার কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, অন্য কোনো দেশের নেতা বা রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী আসলে বিমানবন্দের এমন স্লোগান দিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয় কিনা? তিনি একটু ইতস্তত বোধ করে উত্তর দেন, এটা কেবল-ই ঘটে আমাদের বাংলাদেশ, ক্ষেত্র বিশেষে ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে।

তবে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা এবার বিশাল একটি কাজ করেছেন, তিনি বিশ্বে মানবতার নেত্রী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করিয়েছেন। সেটা একটা বিশাল অর্জন আমাদের জন্য। তাই আমরা প্রবাসীরা এবার এখানে এসেছি বিশেষভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে।

অন্যদিকে, কয়েক ভাগে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতাকর্মীরা বিমানবন্দরের বাইরে শেখ হাসিনাকে গণতন্ত্র হত্যাকারী এবং খুন-গুমের নেত্রী বলে নানা স্লোগান দিতে থাকেন।

তবে প্রধানমন্ত্রী নিরাপদে বিমানবন্দর ত্যাগ করার পর তারা স্লোগান দিতে থাকেন, ‘এই মাত্র খবর এলো, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল।’
এখানে উপস্থিত একজন নেতা তার ভাষণে বলছিলেন, ‘আমাদের তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলনে ভীত হয়ে শেখ হাসিনা এবং যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তাদের পাণ্ডারা পালিয়ে গেছেন।’

তবে এই স্বাগত বা প্রতিবাদ কর্মসূচির সবই ঘটেছে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টির অগোচরে। জে এফ কে বিমানবন্দরের ৪ নম্বর টার্মিনালে অবতরণের পর বিশেষ নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সরকারপ্রধান বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। অবশ্য টার্মিনালের ভেতর বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী নেতা তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। আর বাইরের এই স্বাগত সমাবেশ বা প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে গাড়ি পার্কিং এলাকায়।

স্থানীয়ভাবে নাগরিক অধিকার আর মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন ড্রাম’র সংগঠক কাজী ফৌজিয়া তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এই প্রতিবাদ-স্বাগত সমাবেশ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

তিনি লিখেছেন, ‘আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশ কি জে এফ কে বিমানবন্দরে এইভাবে বরণ আর বর্জনের লোকবল নিয়ে হাজির হয়! কেউ জানলে জানাবেন। আমি বাঙালি সমাজের এই তামাশায় ক্লান্ত। আর ভাই, প্রধানমন্ত্রী আসলেই তোমাকে কেন কাজ ফেলে দৌড়াতে হবে বরণ করতে বা বাধা দিতে! সে তোমার বাধা বা বরণের তোয়াক্কা করে না, তোমার কোনো স্বার্থ রক্ষায়ও সে আসেনি তাই নিজের কাজ কর। যদি পার তো যেদিন সে জাতিসংঘে ভাষণ দিবে বাইরে লোকবল জমা করে মিয়ানমারের অত্যাচারের সুবিচার দাবি করে হাসিনাকে সাহায্য কর। মনে রাইখ রোহিঙ্গা সমস্যা হাসিনা সরকারের সমস্যা নয় রাষ্ট্রের সমস্যা। বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক করপোরেশন স্বার্থ রক্ষার গিনিপিগ। সবাই বাংলাদেশের কাঁধে রোহিঙ্গা রিফিউজি চাপিয়ে দিয়ে নিজের মুনাফা দেখছে।
এইবার যদি হাসিনা সরকারের জাতিসংঘ সফর দল কূটনৈতিক তৎপরতায় বিফল হয়ে শুধু শোডাউন করে চলে যায়, তবে রোহিঙ্গা সমস্যা জীবনভর বাংলাদেশের।’

নিউইর্য়কে বাংলাদেশি সরকারপ্রধান বা বিরোধী রাজনীতির কেউ আসলে দলে দলে মানুষ যান সেখানে স্বাগত জানাতে, অন্য পক্ষ যান প্রতিবাদ জানাতে। এটা অনেক দিনের রীতি, তবে সেটি শুধু বাংলাদেশিদের বেলায়।

স্থানীয় এক ট্যাক্সিচালক বলছিলেন, ‘আমরা তো বিমানবন্দরে সব সময়ই থাকি, আসি যাই। এখানে অন্য কোনো দেশের মানুষ তাদের নেতাকে নিয়ে এমন আচরণ করেন না। কিন্তু, বাংলাদেশিদের যেন কাজ নেই। নেতাকে চেহারা দেখানোর জন্য, এই এলাকা আটকে রাখেন, আমাদের শৃঙ্খলাবোধের অভাব আছে।’

অবশ্য এ নিয়ে ভিন্ন মতও আছে। স্থানীয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আবু তাহের তার টিভিতে প্রধানমন্ত্রীর এই আগমন সরাসরি সম্প্রচার করছিলেন।

সেখানে এক মন্তব্যে তিনি এটিকে অনুকরণীয় একটি দৃষ্টান্ত বলেই মন্তব্য করেন।

অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে আবু তাহের বলেন, ‘এটা অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের বেলায় হয়, সেটা আমি শুনিনি বা দেখিনি আমার প্রায় ২৫ বছর জীবনের সাংবাদিকতায়। তবে আমি মনে করি, এটার ভালোমন্দ দুই দিক-ই আছে। এটা আমাদের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য যে, এখানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিপক্ষে সমাবেশ হয়েছে। এটা পুলিশের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই হয় এবং আগে থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত থাকে যেন কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।’

প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন এবং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাবেন বলে মনে করছেন তার আগমনের প্রতীক্ষায় থাকা এসব প্রবাসী।