‘পেটে গুলির ক্ষত, ১২ দিন হেঁটে বাংলাদেশে এসেছি’

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাষ্ট্রীয় খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন ও উচ্ছেদের শিকার হয়ে সম্প্রতি চার লাখ নয় হাজার (জাতিসংঘের দেওয়া সর্বশেষ হিসাব) রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতসহ বিভিন্ন দেশেই তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

গত ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরু হওয়ার পর পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা থাকা, খাওয়া, পোশাক, অপুষ্টিসহ অসংখ্য সমস্যার মধ্যে করছে মানবেতর জীবনযাপন। তাঁদেরই একজন ৫০ বছর বয়সী আরবা খাতুন। তিনি কয়েক সপ্তাহ আগে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের নতুন করে তৈরি করা একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি দুর্বিষহ শরণার্থী জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন আলজাজিরার প্রতিবেদককে। সেই প্রতিবেদন বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।

‘আমি আরবা খাতুন, বয়স ৫০। রাখাইনে সহিংসতা শুরু আগে আমার জীবন ভালোই কাটছিল। আমার গৃহপালিত কিছু প্রাণী ছাড়া জমিও ছিল। সেখানে আমি ধান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করতাম। কোনো না কোনোভাবে আমাদের জীবন কেটে যাচ্ছিল। আমার স্বামী ১৫ বছর আগে মারা যান। তখন থেকেই আমি আমার ছেলে ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে ছিলাম। যখন আমি যুবতী ছিলাম, তখন আমি কৃষিকাজ করতে ভালোবাসতাম। এখন তো আমি বৃদ্ধ, আমার ছেলেই অধিকাংশ কাজ করে।

আমার ঠিক দিন-তারিখ মনে নেই; একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি মুখ ধুচ্ছি, এমন সময় সেনাবাহিনীর লোকেরা আমাদের খামারে আসে এবং সেখানে থাকা পশুগুলোকে চুরি নিয়ে যায়। তখন তারা আমাকে দেখতে পেয়ে গুলি করে এবং গুলির একটি অংশ আমার পেটে এসে লাগে। ভাগ্য ভাল যে, সেটি খুব বেশি ভিতরে যায়নি, তবে খুব ব্যাথা হচ্ছিল আর রক্ত ঝরছিল। তখন আমার ছেলে আমাকে কাছের এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়।

চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিরে এসে দেখি, সারা গ্রামে আগুন জ্বলছে। তখন আমার ছেলে আমাকে নিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যায়। সেখানে গিয়ে আমরা পরিবারের অন্য সদস্যদেরও খুঁজে পাই।

তিন দিন সেখানে আমি শুয়েছিলাম, তারপর আমরা বাংলাদেশের দিকে পথ দিই। কিন্তু আমরা বাড়ি থেকে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। কারণ, আমার ছেলে আমাকে আর তাঁর স্ত্রী ও দুই বাচ্চাকে বহন করে নিয়ে আসতে হয়েছে। টানা ১২ দিন কষ্টকর পথ পাড়ি দিয়ে আমরা বাংলাদেশে এসে পৌঁছাই। আমরা শুনেছিলাম, সীমান্তে কিছু সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু আমরা খুব সহজেই আসতে পেরেছি।

বাংলাদেশে আসতে পেরে আমি খুবই খুশি। কারণ, এখানে আমাদের জীবন নিরাপদ। গুলি লাগার জায়গাটা একটু শুকানোয় আমি প্রচুর হাঁটতেও পেরেছি। কিন্তু আমরা তো সঙ্গে করে কোনো খাবার আনতে পারিনি এবং এখানে কোনো খাবার পাচ্ছি না। কোনো সাহায্য না পাওয়ায় আমাদের অভুক্ত থেকে দিন কাটাতে হচ্ছে।

বিশ্ববাসীর কাছে আমার ছেলে সাহায্য চেয়েছে মিয়ানমারে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি আর সেখানে যেতে রাজি নই। কারণ, মিয়ানমারে আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। আমাদের এখানে থাকার চেষ্টাই করা উচিত।’