প্রভাবশালীদের ছোবলে পাহাড় উজাড়

প্রভাবশালীদের লোভের শ্যেনদৃষ্টিতে পুড়ছে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো। কেউ পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ করে বস্তি ভাড়া দিচ্ছে। কেউ বা প্লট বিক্রি করে আয় করছে কোটি কোটি টাকা। আবার কেউ বা রাবার বাগান, চা বাগানসহ বিভিন্ন বাগান করার নামে পাহাড় লিজ নিয়ে সেসব পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলছে। ব্যবহার করছে অন্য কাজে।

বিশেষ করে তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারে পর্যটনের নামে ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন পাহাড় লিজ ও বন্দোবস্ত নিয়ে যে যার মতো করে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটছে। নির্মাণ করছে স্থাপনা। তিন পার্বত্য জেলায় বন উজাড়েও জড়িত রয়েছে শক্তিশালী কাঠ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।

যখন যে সরকার আসে সে সরকারের প্রভাবশালী লোকজন কিংবা তাদের ছত্রছায়ায় থেকেই পাহাড়খেকোরা প্রতিনিয়ত মেতে ওঠে অশুভ খেলায়। যে কারণে একদিকে পাহাড়ে ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে অনেক পাহাড়।

অন্যদিকে পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নেয়া হতদরিদ্র মানুষগুলো হচ্ছে পাহাড়খোকোদের অবৈধ উপার্জনের নির্মম বলি। প্রতি বছরই বর্ষা মেৌসুমে ধসে পড়ছে পাহাড়, মাটির নিচে চাপা পড়ছে মানুষ।

চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারে গত প্রায় দুই দশকে তিন শতাধিক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। সর্বশেষ সোমবার টানা কয়েকদিনের বর্ষণে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, পার্বত্য রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড় ধসে ১৫৩ জনের মৃত্যু হয়। রাঙ্গামাটির সবুজ পাহাড় পরিণত হয়েছে রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব থাকার কারণে পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশি্লষ্ট প্রশাসন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংস’র কারণে প্রশাসনও ম্যানেজড হয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। যার কারণে পাহাড় কাটা, দখল ও অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধ হচ্ছে না।

এদিকে সর্বশেষ পাহাড় ধসে বিপর্যয়ের পর বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের লালখান বাজার মতিঝরনার কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি বলেন, অনেক হয়েছে আর নয়। পাহাড় কেটে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন করা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের উচ্ছেদ করা হবে। পাহাড় কেটে বসতি স্থাপনে সুযোগ করে দেয়া কোনো পক্ষ যদি বাধা দিতে আসে তবে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। কারণ এটা লাখ লাখ মানুষের জীবনের ব্যাপার। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, কেবল চট্টগ্রাম মহানগরীতেই ৩০টি পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি এসব পাহাড় চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু পাহাড় একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় পাহাড় যেমন রয়েছে বেশি, তেমনি এই এলাকায় পাহাড় কাটাও চলছে। এই এলাকায় বর্তমান ও সাবেক অনেক মন্ত্রী, এমপি ও মেয়রের নামে রয়েছে পাহাড়। যেসব পাহাড়ের অধিকাংশই কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে। নির্মাণ করা হচ্ছে শিল্প-কারখানা, আবাসন প্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা।

বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার আরেফিন নগরের পাহাড় একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চন্দ্রনগর পাহাড় কাটা চলছেই। উইমেন ইউনিভার্সিটির পরের একটি পাহাড় এখন ছিন্নমূল পাহাড় নামে পরিচিতি পেয়েছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় থেকে বিভিন্ন সিন্ডিকেট এসব পাহাড় কেটেছে।

অভিযোগ আছে, বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ ও পরিবেশ অধিদফতরের লোকজনকে ম্যানেজ করেই পাহাড় কাটা চলে এখানে। কোথাও কোথাও রীতিমতো এস্কেভেটর লাগিয়ে প্রভাবশালীরা পাহাড় কাটে। সীতাকুণ্ডের সলিমপুরে অধিকাংশ পাহাড় কেটে প্লট আকারে বিক্রি করেছে পাহাড়খেকোরা। নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামেই রয়েছে পাহাড়। তার পাহাড়েও রয়েছে অবৈধ স্থাপনা। মানিক পাহাড় কেটে বস্তি বানানো হয়েছে। নিম্ন আয়ের লোকজনের কাছে ভাড়া দিয়ে আদায় করা হয় টাকা।

৫ মে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৬তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জানানো হয়, নগরীতে ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে। কাটার ফলে এসব পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এছাড়া নগরীর মতিঝরনা, বাটালিহিল, খুলশী, পাহাড়তলী, টাইগারপাস, আমবাগান, বাটালিহিল রেলওয়ে কলোনি, পাহাড়তলী রেল কলোনি, হাটহাজারী উপজেলার ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী সিটি কর্পোরেশন ওয়ার্ডের শাহ আমানত কলোনি, কাছিয়াঘোনা, লেবু বাগান এলাকায় পাহাড় রয়েছে। যেখানে পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে উঠেছে।

পরিবেশ আন্দোলন কর্মী শরীফ চৌহান বলেন, পরিবেশ অধিদফতর ও পুলিশের উদাসীনতা, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের রহস্যজনক সহযোগিতার কারণে পাহাড় রক্ষা করা যাচ্ছে না। প্রশাসনের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি করার কারণেও পাহাড় কাটা বা ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অবৈধভাবে পাহাড়ের পাদদেশে ঘর তৈরি করে ভাড়া দেয়। ফলে অনেক সময় প্রশাসন চষ্টো করলেও তাদের উচ্ছেদ করতে পারে না।’

পাহাড় রক্ষায় সরকার, রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে তিনি জানান।

পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মহানগর অঞ্চলের পরিচালক মো. আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, তারা যেখানেই পাহাড় কাটার খবর পান সেখানেই অভিযান পরিচালনা করেন। এ পর্যন্ত তিনি কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা হস্তক্ষেপের শিকার হননি বলেও দাবি করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারেও অবাধে পাহাড় কাটা চলছে। জেলা শহর ও এর আশপাশের পাহাড় যে যেভাবে পারছে দখল করে নির্মাণ করছে অবৈধ, অননুমোদিত ও অপরিকল্পিত স্থাপনা। আবার জেলা শহরের বাইরে বিভিন্ন দুর্গম উপজেলায় পাহাড় বন্দোবসি্ত নিয়ে রাবার বাগান, চা বাগান, হটিকালচার বা উদ্যান উন্নয়নের নামে পাহাড় লিজ নিয়ে প্রভাবশালীরা তা কাটছে।

বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারে পর্যটনের নামে নির্মাণ করা হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। এ ক্ষেত্রে তারা অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনের তোয়াক্কা করে না। পর্যটন মন্ত্রণালয় কিংবা শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বিচারে পাহাড় কাটছে।

বান্দরবানের রুমা বাসস্টেশন থেকে চিম্বুক নীলগিরি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে অনেক আবাসিক ভবন। শহরের হাফেজঘোনা সিঅ্যান্ডবি পাহাড়ের একাংশ কেটে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক হোটেল। বান্দরবানের মিলনছড়ি ও মেখলা এলাকায়ও পাহাড় কেটে আবাসিক হোটেল ও ভবন নির্মাণের মহোত্সব চলছে।

তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রাবার বাগান, চা বাগান বা উদ্যান উন্নয়নের নামে লিজ পাওয়া পাহাড়ও নির্বিচারে কাটা হচ্ছে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। তিন পার্বত্য জেলায় শক্তিশালী কাঠ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট রয়েছে যারা প্রতিনিয়ত পাহাড়ের গাছ কেটে চোরাইপথে শহরে পাচার করে। এ ক্ষেত্রেও তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটায়। পর্যটন নগরী কক্সবাজারে গত পাঁচ বছরে পাহাড় কেটেই গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত ৩০ হাজার স্থাপনা।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা লক্ষ্মীপদ দাস জেলায় পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতভাবে আবাসিক হোটেল ও বসতি স্থাপনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

তিনি জানান, সেতুমন্ত্রী বান্দরবানে পরিদর্শনকালে তাকেও এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। সুষ্ঠুু নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে পাহাড় রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নয়তো পাহাড় ধস ও বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খান তেৌহিদ ওসমান বলেন, পাহাড়ি এলাকার বনজঙ্গল ধ্বংস করা হচ্ছে। কেটে ফেলা হচ্ছে গাছপালা। উজাড় করা হচ্ছে বন। অব্যাহত রয়েছে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন। এতে করে পাহাড়ের ‘অভ্যন্তরীণ বন্ধন’ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই দুর্বলতার কারণে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হুড়মুড় করে পাহাড় ভেঙে পড়েছে। ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ থাকার কারণে পাহাড়ে বনজ আমেজ থাকে। থাকে নিজস্ব একটা শক্তি। কিন্তু সেই শক্তিটা হারিয়ে ফেলছে পাহাড়। সৃষ্টি হচ্ছে ফাটল। যার কারণে অল্পবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিতে পানি ঢুকে পাহাড় ভারি হচ্ছে। ভার সইতে না পেরে ধসে পড়ছে। এ জন্য প্রকৃতি নয়; মানুষই দায়ী। এটা বন্ধ করা না হলে প্রকৃতির দান এই পাহাড়গুলো রক্ষা করা যাবে না। পরিবেশের ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যার ক্ষতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে।খবর যুগান্তরের।