প্রশান্ত মহাসাগরে তলিয়ে যাওয়া উড়োজাহাজ থেকে যেভাবে বেঁচে গেলেন দুই পাইলট!

প্রশান্ত মহাসাগরে তলিয়ে গেল উড়োজাহাজ, বেঁচে রইলেন দুই পাইলট। জেলিফিশের কামড়ে জ্ঞান হারিয়েও মারা যাননি তাদের একজন। এবার এলো এক হাঙর। দু’জনের চার পাশে চক্কর দিতে থাকল সেটি। এবারও বেঁচে গেলেন তারা। কিভাবে? বিদেশী সাময়িকী অবলম্বনে সে কাহিনী জানাচ্ছেন হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী

দুই ইঞ্জিনের পাইপার অ্যাপাচি বিমানটি উড়ছিল পোস্টকার্ডের মতো নীল রঙের আকাশের নিচে এবং প্রশান্ত মহাসাগরের পাঁচ হাজার ফুট ওপর দিয়ে। বিমানটি চালাচ্ছিলেন নারী বৈমানিক সিডনি উয়েমেতা (২৩) আর কো-পাইলট ছিলেন ২৬ বছর বয়সী ডেভ ম্যাকমাহন। বলে রাখা ভালো, পাইলট ও কো-পাইলট ওই দিন প্রথম একে অপরকে দেখলেন। বিমান উড়ানোর আগে একটা শর্ট ট্রিপ দিচ্ছিলেন তারা। তাই বিমানে কোনো যাত্রীও ছিল না।

বিমানটি যাচ্ছিল ওয়াহু থেকে হাওয়াই দ্বীপে। হঠাৎ একটা বিদঘুটে শব্দ শুনলেন পাইলট ও কো-পাইলট দু’জনেই। এর পরই বিমানের ইঞ্জিনের যে স্বাভাবিক শব্দ, সেটা পাল্টে গেল। ইঞ্জিনটি কেমন একটা বিদঘুটে ঘটঘট শব্দ করতে থাকল।
বেলা তখন ৩টা। বিদঘুটে শব্দটি শোনার পরপরই কো-পাইলট ম্যাকমাহন বিমানটিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের এক হাজার ফুট ওপরে নামিয়ে আনলেন। তাতে মনে হলো, ইঞ্জিনটি এবার যেন একটু ভালোই চলছে। কিন্তু এতে যে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন সে সময়টুকুও পেলেন না। চোখের পলক ফেলার আগেই ভোজবাজির মতো ডান দিকের ইঞ্জিনটা অচল হয়ে গেল। কী হলো দেখা ও বোঝার আগেই বাম দিকেরটাও। নিঃসীম সমুদ্রের ওপর, নিজেদের ধাতব কম্পার্টমেন্টে বসে সিডনি ও ম্যাকমাহন যা শুনলেন, এ রকম পরিস্থিতিতে সব পাইলটই তা শুনে থাকে : ভয়াল নৈঃশব্দ্য। তারা ভাবলেন, এবার আমরা বুঝি ক্রাশ করতে (বিধ্বস্ত হতে) যাচ্ছি।

এর পরের ক’ মিনিট তারা পাগলের মতো অনেক কিছু করলেন। বিমানটি তখন দ্রুত নিচের দিকে নামছে। দুই পাইলট ফুয়েল পাম্প চেক করলেন, এর হাতল ধরে জোরে টান দিলেন। এভাবে করলে অনেক সময় বন্ধ ইঞ্জিন চালু হয়ে যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হলো না।
এরকম জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, তার কিছু প্রশিক্ষণ তাদের ছিল। সে অনুযায়ী ম্যাকমাহন উড়োজাহাজটির কন্ট্রোল ছেড়ে দিলেন উয়েমোতোর হাতে। উড়োজাহাজের ভেতরটা তখন গরম বাতাসে ভরে গেছে। তার হাত থেকে বাঁচতে ম্যাকমাহন ককপিটের দরজা খুলে দিলেন। এখন উড়োজাহাজটি সমুদ্রের পানিতে ডুবে গেলেও ওরা আর ওটির ভেতরে আটকে থাকবেন না।
উড়োজাহাজটি যখন সমুদ্রের ৩০০ ফুটের মধ্যে চলে এসেছে, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে তার শেষ বার্তাটি দিলেন উয়েমোতো, ‘আমরা কোনা থেকে ২৫ মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে আছি। আমরা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি।’

উয়েমোতো শক্ত হাতে উড়োজাহাজের কন্ট্রোল চেপে ধরে আছেন। পাইলট স্কুলে তাদের শেখানো হয়েছে সমুদ্রে কিভাবে ফোর্স ল্যান্ডিং করতে হবে। কিন্তু ওসব তো কেতাবি কথা, বাস্তবে যে এর প্রয়োগ করতে হবে, তা কে জানত? উয়েমোতোর বুঝতে বাকি রইল না যে তাদের বাঁচার আশা ক্ষীণ। কী করা যায়!

উয়েমোতো ভাবলেন, যদি উড়োজাহাজটিকে একটু বাঁকিয়ে সরাসরি পানির ওপর ফেলি তবে যে ধাক্কাটা খাবো তাতে আমরা দু’জনই মরব। আর যদি একটা পাখাকে প্রথমে পানির ওপর ধাক্কা দিতে দেই, তাহলে পুরো উড়োজাহাজটিই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

তাহলে উপায়? উয়েমোতো এবার নিজেই নিজেকে বললেন, ‘এমনভাবে ল্যান্ড করো, যেন তুমি মাটিতে ল্যান্ড করছো’। উড়োজাহাজটি যখন তীব্র গতিতে সমুদ্রের দিকে নামছিল, উয়েমোতো তখন জোর করে কল্পনা করতে থাকলেন, ওখানে পানির ওপর একটি রানওয়ে আছে। প্রবল বাতাস উয়েমোতোর কান দু’টিকে যেন বধির করে দিতে চাইল। সমুদ্র যেন এ সময় তাদের সাথে ‘সাক্ষাতের’ জন্য ফুলে উঠছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে এক কাজ করে বসলেন উয়েমোতো। তিনি উড়োজাহাজের নাকটি একটু খাড়া করে দিলেন।
সব কিছু ঠিকমতোই হলো। প্রচণ্ড গতিতে উড়োজাহাজটি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিপুল পানি এসে উইন্ডস্ক্রিনকে ছাপিয়ে দিলো। উয়েমোতো ও ম্যাকমাহন তাদের আসন থেকে ছিটকে পড়লেন।

একটু পরেই চোখ খুললেন ম্যাকমাহন। বুঝলেন, অলৌকিকভাবে হলেও তিনি এখনো বেঁচে আছেন। ঠিক আছে, কিন্তু উয়েমোতো কোথায়? তাকিয়ে দেখেন তার পেছনেই লুটিয়ে আছেন উয়েমোতো। আহত ও রক্তাক্ত, কিন্তু সজ্ঞান। উড়োজাহাজের খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে পানি ঢুকছে। ম্যাকমাহন ভাবলেন, ‘বেঁচে যখন আছি তখন এখান থেকে বেরোতে হবে এবং একটুও দেরি করা চলবে না।’ তিনি দ্রুত সিটবেল্ট খুলে ফেললেন এবং সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। এরপর উয়েমোতোর উদ্দেশে চেঁচালেন, ‘বেরিয়ে এসো, সিডনি!’

ম্যাকমাহনের চিৎকার শুনে তার দিকে ক্লান্ত ও হতাশ চোখে তাকালেন উয়েমোতো। তার হাত তখনো উড়োজাহাজের কন্ট্রোলের ওপর। ম্যাকমাহন আবার ডাকলেন, ‘বেরিয়ে এসো!’ ডুবন্ত উড়োজাহাজটির ভেতরে তখন হাঁটুপানি। যেকোনো মুহূর্তে ওটি সমুদ্রের পানিতে ডুবে যেতে পারে। ম্যাকমাহনের চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলেন যেন উয়েমোতো। বললেন, ‘সমুদ্রে নামলে হাঙরে ধরবে না?’
‘ওসব পরে। যা হবার হবে।’ বললেন ম্যাকমাহন। উয়েমোতো এবার দরজার দিকে এগোলেন। তার আগে নিয়ে নিলেন দুটো লাইফ জ্যাকেট। বেরিয়ে এসে উড়োজাহাজের পাখা ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওটি সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে গেল। সমুদ্র মুছে দিলো সব চিহ্ন, যেন ওখানে কখনোই কিছু ছিল না। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশিতে ভেসে রইল ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো দুটো মানবশরীর।

সমুদ্রে শয়ান যার
সমুদ্র যেন ওদের অপেক্ষায় ছিল। পানিতে নামতেই ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ওদের জড়িয়ে ধরল। পানির ছোঁয়া পেতেই ম্যাকমাহনের শরীর ও মনটা হঠাৎ শান্ত হয়ে এলো। ভাবল নিজের কথা আরে, আমি তো এই ওয়াহু এলাকারই ছেলে। সমুদ্রতীরে জন্মেছি, এর পানিতে খেলা করেছি, সারফিং করেছি, সাঁতার কেটেছি, নৌকা চালিয়েছি। এখন আমরা দু’জন একটু কষ্ট করে ভেসে থাকতে পারলেই হবে। কোস্টগার্ড তো জানেই কোথায় আছি আমরা। ওরা তো আসবেই।

উয়েমোতোর ভাবনাটা কিন্তু ম্যাকমাহনের ঠিক উল্টো। ভীষণ ভয় পেয়ে ভেঙে পড়েছেন তিনি। তাকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলেন ম্যাকমাহন। ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে টুকটাক কথা বলতে থাকলেন তিনি। উয়েমোতোকে বললেন, ‘তোমার বাড়ির কথা বলো। তোমার ভাইবোন ক’জন?’

‘আমার একটা বোন আছে’। হাবুডুবু খেতে খেতে বললেন উয়েমোতো। তারপর জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, কোস্টগার্ড কখন আসবে?’
‘ওরা এই এলো বলে। আমাদের ততক্ষণ ভেসে থাকতে হবে কষ্ট করে।’ জবাব দিলেন ম্যাকমাহন।
কয়েক ঘণ্টা পর ম্যাকমাহনের কথা ‘সত্য’ হলো। আকাশে দেখা গেল মার্কিন নৌবাহিনীর একটি বিমান; পুরো এলাকায় চক্কর দিচ্ছে। বিমানটি ওরা দু’জনের ঠিক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। ম্যাকমাহন তার লাইফ জ্যাকেট দুলিয়ে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। কিন্তু তাদের দিক থেকে দেখতে পাওয়ার পর কোনো ইশারা মিলল না, আগের মতোই চলতে থাকল এবং একটু পরেই দিগন্তে হারিয়ে গেল।

এর পরের কয়েক ঘণ্টা একের পর এক উড়োজাহাজ ওদের খোঁজে ওদেরই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। ওরাও প্রাণপণ চেষ্টা করল উদ্ধারকারীদের চোখে পড়ার। কিন্তু একটি উড়োজাহাজও ওদের কেন যেন দেখতে পেল না।

আঁধার এলো নেমে
বিকেল হয়ে এলো। সূর্য ক্রমেই ম্রিয়মাণ হতে থাকল আর যেন সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়েই ম্যাকমাহনের শান্ত ভাবটিও ক্রমেই ভেঙে পড়তে লাগল। তিনি এলোমেলো হয়ে গেলেন। ভাবলেন, এই রাতটা আমাদের পানিতেই কাটাতে হবে! তার চেহারায় ভয়ের ছায়া দেখতে পেলেন উয়েমোতো।

এ সময় উয়েমোতো অনুভব করলেন, সমুদ্রের পানি দিকবদল করেছে, ঢেউ এখন দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী। উয়েমোতো হাওয়াইর মেয়ে। সব হাওয়াইবাসীর মতো তিনিও জানেন, অ্যান্টার্কটিকার আগে হাওয়াইর দক্ষিণে আর কিছু নেই। আর অ্যান্টার্কটিকা? সে তো ১১,৯৯০ কিলোমিটার দূরের পথ! উয়েমোতো ও ম্যাকমাহন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, ওই যে কাইলুয়া কোনা আগ্নেয়গিরির আবছা ছায়া দেখা যাচ্ছে, ওদিক পানেই সাঁতার কাটতে হবে। ওটাও ৪০ কিলোমিটার দূরে যদিও।

রাত ১০টা নাগাদ উয়েমোতোর পা দুটো অবশ হয়ে এলো। তিনি এবার শুধু হাতেই সাঁতরাতে থাকলেন। অল্প কিছুক্ষণ পর ম্যাকমাহনের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে এলো। দীর্ঘ আট ঘণ্টা ধরে সাঁতার তাকে একেবারে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। প্রথম কয়েক ঘণ্টা ম্যাকমাহনই নানাভাবে সাহস জুগিয়ে এসেছিল উয়েমোতোকে, এবার পাশার দান উল্টে গেল, দায়িত্বটি নিলেন উয়েমোতো। নিজের অচল পা-দু’টি দিয়ে জড়িয়ে নিলেন ম্যাকমাহনের দুই বাহু। তার পিঠের ওপর ম্যাকমাহন মাথা রাখলেন। হঠাৎ তার মনে হলো, এভাবে চললে আমি ডুবে মরব। তিনি এবার উয়েমোতোকে ডাকলেন, ‘সিডনি, আমি আর পারছি না।’

উয়েমোতো নিজেকে ম্যাকমাহনের বাঁধন থেকে মুক্ত করলেন এবং দু’জন মুখোমুখি হলেন। কী করা যায় এই বেপরোয়া ভাবনা থেকেই তিনি ম্যাকমাহনের লাইফ জ্যাকেটটি পরীক্ষা করতে চাইলেন। খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল না ওটা। নানা রকম টুকটাক করে ওটাকে এমন করা হলো যে, এর সাহায্যে ম্যাকমাহন অন্তত ভেসে থাকতে পারবেন। তা-ই হলো। ম্যাকমাহন এবার উয়েমোতোর হাঁটু জড়িয়ে ধরে বিশ্রাম নিতে এবং হারানো শক্তি সঞ্চয় করতে থাকলেন। আর উয়েমোতো সাঁতার কেটে চললেন উপকূলের দিকে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতে কাটতেই উয়েমোতোর মনটা কেমন যেন ভারশূন্য হয়ে এলো। আকাশে চাঁদ উঠেছে; উজ্জ্বল, গোলাকার। সাগরের পানিতে জ্যোৎস্না কেমন খেলা করছে। দূরের পর্বতমালা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চাঁদের আলোয়। অদ্ভুত এক ভাবনা খেলে গেল উয়েমোতোর মনেÑ এই যে মানুষটা, এর সাথে তো আগে কোনো দিন একটি কথাও হয়নি, অথচ সে-ই এখন আমার সাথী! সমুদ্রে একা ভেবে থাকা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হতো। কিন্তু সাথে এই মানুষটি থাকায় এই মহা বিপদকেও খানিকটা সহনীয় মনে হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে উয়েমোতো নরম গলায় ডাকলেন, ‘হেই, ডেভ!’
জবাব এলো, ‘হেই, সিডনি!’
‘ভালো আছো?’
‘হ্যাঁ, তুমি?’
ম্যাকমাহন এতক্ষণ উয়েমোতোর দুই পা জড়িয়ে ধরে ছিলেন। উয়েমোতো হঠাৎ পায়ে ব্যথা অনুভব করলেন। তিনি ম্যাকমাহনের হাত দুটো সরিয়ে দিলেন। হঠাৎ চাঁদের আলোয় তিনি দেখলেন, তার দুই বাহু বেয়ে সাদা, রেশমি কী যেন উঠছে। আরে, এ তো জেলিফিশ! জেলিফিশের কামড় খেলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নাউসিয়া হয়ে যাবে। নাউসিয়া মানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, সারা শরীর ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট। আর এই দুর্বল শরীর নিয়ে উয়েমোতোর কি না সেটাই হতে যাচ্ছে! তিনি প্রবল বেগে তার শরীর থেকে জেলিফিশগুলোকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ততক্ষণে জেলিফিশ কামড় বসিয়েছে তার শরীরে। তিনি বুঝতে পারলেন, ভয়ানক বিষ তার শরীরে ‘কাজ’ করতে শুরু করেছে। তার সারা শরীর ব্যথা করতে শুরু করেছে। তিনি শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলেন এবং মুহূর্তেই জ্ঞান হারালেন।
প্রবল আতঙ্ক নিয়ে ম্যাকমাহন দেখলেন তার চোখের সামনেই উয়েমোতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি কাতর গলায় ডাকলেন, ‘সিডনি!’ পাগলের মতো তাকে কাছে টেনে নিয়ে তার মাথাটা যাতে পানিতে ডুবে না যায় সেই চেষ্টা করলেন আর বারবার বলতে থাকলেন, ‘সিডনি, আর ইউ ওকে?’

হঠাৎ খানিকটা জ্ঞান ফিরে এলো উয়েমোতোর। আধখোলা চোখে, দুর্বল গলায় বললেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের একটু বিরতি (সাঁতার কাটায়) দেয়া দরকার।’ তা-ই হলো। তারা কয়েক মিনিট শুধু ভেসে রইলেন। উয়েমোতো বললেন, ‘আমি এই জেলিফিশের জ্বালা আর সহ্য করতে পারছি না।’

ম্যাকমাহন বললেন, ‘আমাদের আবার সাঁতার শুরু করা উচিত মনে হচ্ছে।’ এ সময় উয়েমোতোও খানিকটা শক্তি ফিরে পেলেন। দু’জনেই ফের তীর অভিমুখে সাঁতার শুরু করলেন।

আবার সূর্য ওঠে
রাত কেটে যায়। ভোর হয়। আবার সূর্য ওঠে। সাগরে ভাসমান দুই বৈমানিককে স্বাগত জানান অপূর্ব সুন্দর এক দৃশ্যÑ হাওয়াই দ্বীপ; সবুজ ও রাজকীয়। দ্বীপটি যতো দূরে বলে তারা কল্পনা করেছিলো, তার চেয়েও অনেক কাছে। তার মানে, জেলি ফিশের উৎপাত এবং চরম ক্লান্তি নিয়েও সারা রাত সাঁতার কেটে অনেক এগিয়েছে তারা।

সারাটা সকাল তাদের নিচ দিয়ে ভেসে চলল ছোট ব্ল্যাক ফিশের ঝাঁক, যেন ভেসে চলা দু’জন মানুষকে সঙ্গ দিচ্ছে তারা। উয়েমোতো ভাবলেন, অন্য যেকোনো সময় হলে এটি হতো অসাধারণ একটি সমুদ্রভ্রমণ। ঈষদুষ্ণ সাগরজল এতটাই স্বচ্ছ ও নীল, যেন আমরা ইচ্ছে করলে এর তলদেশ পর্যন্ত দেখে নিতে পারি।

ভাবতে ভাবতে উয়েমোতো দেখলেন, তাদের সাথে ভেসে চলা ব্ল্যাক ফিশের ঝাঁকটি হঠাৎ কেন যেন ভয় পেয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। উয়েমোতো দেখলেন কিসের যেন একটি ছায়া তার সামনে। আতঙ্কে তার শ্বাস গলায় আটকে গেল।
ছায়াটি ম্যাকমাহনও দেখেছিলেন একটি হাঙর। পানির উপরিভাগ থেকে তিন মিটারের মতো নিচে। আতঙ্কিত উয়েমোতো ভাঙা গলায় বললেন, ‘এখন কী হবে? আমরা কোথায় যাবো?’

ম্যাকমাহন বললেন, ‘নড়াচড়া কোরো না। জাস্ট সামনের দিকে তাকিয়ে যেমন সাঁতার কাটছিলে তেমনি সাঁতার কাটতে থাকো।’
হাঙরটি তাদের দু’জনের চার পাশে নিয়ম করে চক্কর দিতে থাকল। ম্যাকমাহন ভাবলেন, হাঙরটি তো ভালোই। এটি বোধ হয় আমাদের খেতে আসেনি, দেখতে এসেছে।

দুই বৈমানিকের চার পাশে প্রায় আধঘণ্টা চক্কর দিলো হাঙরটি, তারপর উধাও হয়ে গেল। তারপর আধঘণ্টা পর আবার ফিরে এলো। এবার ওটিকে দেখে ম্যাকমাহনের পেট মোচড় দিয়ে উঠল। তার মনে হলো, আমাদের উড়োজাহাজ ক্র্যাশ করেছে, কিন্তু আমরা বেঁচে আছি। রাতভর সমুদ্রে সাঁতার কেটেছি, তাও মরিনি। কিন্তু এবার বোধ হয় আর উপায় নেই, হাঙরের পেটেই বুঝি যেতে হবে।
উয়েমোতো জানতে চাইলেন, ‘হাঙরটি কাছে এলে তুমি কী করবে?’
ম্যাকমাহন বললেন, ‘আমি ওটির চোখ বরাবর ঝেড়ে লাথি কষাবো।’

হাঙরটি যেমন চুপচাপ এসেছিল, একটু পরেই তেমনি নিঃশব্দে চলে গেল। আর উয়েমোতো ও ম্যাকমাহন ফের ‘একা’ হয়ে গেলেন। তারা এখন উপকূল থেকে ১৬ মাইল দূরে। দ্বীপের দৃশ্য পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তারা। এবার তারা দু’জনে একটি ‘সন্ধি’ করলেন, যে-করেই হোক, সূর্য ডোবার আগে তীরে পৌঁছাতেই হবে। উয়েমোতো একটু মজাও করলেন, ‘তারপর কি তুমি খাওয়ার জন্য বাইরে যেতে চাইবে?’
দুপুরের ঠিক আগে তারা আকাশে একটি হেলিকপ্টার দেখলেন। ওটি তাদের মাথার ওপর ডান দিকে উড়ছিল। তারা দু’জনেই ওটির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হাত নাড়লেন। কিন্তু না। আগের হেলিকপ্টারগুলোর মতো এটিও তাদের দেখতে পেল না এবং চলে গেল।
প্রায় ২০ ঘণ্টা কেটে গেছে। উয়েমোতো আর পারছেন না। তার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লড়াইয়ের পর কারো এ রকম মনে হতেই পারে, ‘আর পারছি না। যা থাকে কপালে।’ উয়েমোতো এখন সেই পর্যায়ে। ঠিক তখনই আবার তার কানে এলো হেলিকপ্টারের শব্দ। তিনি ক্ষীণ গলায় চেঁচালেন, ‘আসছে, আবার আসছে।’

ম্যাকমাহন বললেন, ‘হ্যাঁ, সিড! ওটাই এটা। আল্লাহই ওটা আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন।’ হেলিকপ্টারের নজরে পড়তে তারা দু’জনই প্রাণপণে হাত নাড়াতে লাগলেন। হেলিকপ্টারটি তাদের মাথার ওপর এসে থামল।
প্রবল আবেগে উয়েমোতো ও ম্যাকমাহনের চোখে পানি চলে এলো। তারা বেঁচে থাকার আনন্দে পানির মধ্যেই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন। তারা অনুভব করলেন, তারা দু’জন থাকার কারণেই বেঁচে গেছেন। যেকোনো একজন একা হলে আর বাঁচতেন না। দু’জন থাকায় একজন নেতিয়ে পড়লে অন্যজন সাহস দিয়েছেন। উয়েমোতো তার কো-পাইলটকে বললেন, ‘তোমাকে তো আমি চিনতামই না। কিন্তু তুমি বন্ধুত্বের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছো।’

দশ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় আরেকটি হেলিকপ্টার চলে এলো। একটি ধাতব উদ্ধার বাস্কেট নিয়ে বেশ নিচুতে নেমে এলেন একজন উদ্ধারকারী। তারপর প্রথমে উয়েমোতো এবং পরে ম্যাকমাহনকে তুলে নেয়া হলো।
মানুষের জীবনে কত রোমাঞ্চকর ঘটনাই না ঘটে!