ফয়সাল হাবিব সানি’র বিষাদকাব্য সিরিজ থেকে একগুচ্ছ কবিতা

বিষাদকাব্য-১

মাঝে মাঝে কেনো জানি ভাবি, খুব বেশি ভাবি
বিষাদ! সে কি অামার জন্মগত নাম, নাকি বুকের উপর চাপা কোনো নীলাভ পাথর;
যে পাথরের বুকের অতলেও পুঞ্জিভূত কি এক ব্যথা! অজস্র রাত্রির কালো কষ্ট
অাহা, নষ্ট! এ জীবন বড়ো নষ্ট!!

বিষাদকাব্য-২

একদিন এক অনর্থক বৃক্ষ বলেছিলো অামাকে,
যেদিন অামার মতো প্রসারিত হতে পারবে অার রাতারাতি অাজন্ম দুঃসহ ভারবাহী নীরবসহা সুগভীর কষ্ট তোমার চওড়া বুকে বয়ে এ ব্যর্থ জন্মের শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার সংকল্প করতে শিখবে
সেদিন তুমিও `অামি’ হয়ে যাবে!
তোমার সব বিষাদ ঝরে যাবে, যেভাবে প্রতিনিয়ত পত্রশূণ্য হয়ে যায় অামি…
তারপর থেকে বৃক্ষ হবার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি অামি!
এখন অামার সুবিশাল বৃক্ষ হবার দারুণ শখ, জীবনবৃক্ষ হয়ে জীবন থেকে বিষাদের সকল পাতা ঝরাতে চাই, এ অামার অাকাঙ্খা নয়, এ অামার জন্মেরই পূর্বে লভ্য হয়তো কোনো এক নিয়তি সূত্র।

অাচ্ছা, মানুষ কি কখনো বৃক্ষ হতে পারে কিংবা বৃক্ষ মানুষ?
বৃক্ষের পাতা ঝরে গেলে মানুষই পদপিষ্ট করে সেগুলো
অার জীবনের পাতা ঝরে গেলে মানুষই ঝরে যায়…
হয়তো বৃক্ষের থেকে মানুষেরই ঝরে যাবার প্রবণতা বেশি!

বিষাদকাব্য-৩

এ চোখের সাথে একদিন সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম।
সমুদ্র দেখার ইচ্ছে না থাকলেও কোনো একদিন কি কারণে যেন সমুদ্রের ইচ্ছে হয়েছিলো অামাকে দেখার-
তখন সমুদ্রের উচ্ছ্বল যৌবন অামাকেও রোমাঞ্চিত করেছিলো।
কেউ কি জানো, জন্মলগ্ন থেকেই কি এক বিষাদ সমুদ্রের বুকে বসবাস করে!
অামি জানি, সমুদ্রের বুকেও সে কি এক বিষাদ লুকিয়ে রয়েছে! সমুদ্রও তাই বিষাদ থেকে মু্ক্ত নয়; সমুদ্রও বিষাদে ডুবে থাকে
অাবার কখনো কখনো মানুষকেও ডুবিয়ে দেয়!
তবে বিষাদে নয়,
অমোঘ মৃত্যুতে!
লবণের বিষাদে যে সমুদ্র তিক্ত
অামি জানি, তিক্ততায় অন্তবনতি ও পরিণতি তার!

লবণের রঙ সাদা বলে সমুদ্রের বুকে অঢেল জমে থাকা বিষাদের রঙও নির্দ্বিধায় `সাদা’!
কিন্তু মানুষের বিষাদের কোনো রঙ নেই বলে জীবনেরও কোনো রঙ নেই মানুষের;
রঙহীন জীবন নিয়েই তবু মানুষের এতো কিছু…
কেননা বিষাদ ও জীবন সে তো একই সূত্রে অাজন্ম গ্রথিত!
অামার মাঝে মাঝে মনে হয়, বিষাদের কোনো রঙ অাবিষ্কৃত হয়নি বলে জীবনের রঙও অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে অাজও
অার মানুষের বিষাদের কোনো রঙ অাবিষ্কার করা সম্ভব নয় বলে যেন জীবনেরও কোনো রঙ, কোনো বর্ণ অাবিষ্কৃত হবে না এ জন্মে কোনোদিন!
জীবনের কাব্য যেন তাই বিষাদে মোড়ানো কোনো এক অনিবার্য নিয়তি অামাদের…
অার এজন্যই হয়তো এ জন্মের অারেক নাম অামার কাছে `বিষাদকাব্য’!

বিষাদকাব্য-৪

অামার হাতে একটি দেশি চকচকে কয়েন ছিলো সেদিন।
কয়েনের একপিঠে বিষাদ তো অন্যপিঠে জীবন
অনুরূপ কয়েনের একপিঠে জীবন তো অন্যপিঠে বিষাদ!
অামি প্রবল অাগ্রহে কয়েনটি ছুঁড়ে মারলাম অাকাশের দিকে-
কয়েক সেকন্ড পর কয়েনটি এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো;
দেখা গেলো, কয়েনের জীবন পিঠটা অাকাশের দিকে মুখ করে ঘুরে রয়েছে অার বিষাদ পিঠটা মাটির বুকে মুখ করে শুয়ে রয়েছে নিষ্পলক।
অামি প্রবল অাগ্রহে অাবার কয়েনটি অাবারও ছুঁড়ে মারলাম অাকাশের দিকে-
পুনরায় অাগের মতো করে কয়েক সেকেন্ড পর কয়েনটি মাটিতে এসে লুটিয়ে পড়লো;
এবার দেখা গেলো, কয়েনের বিষাদ পিঠটা কেবলই অাকাশ দেখছে অার জীবন পিঠটা মাটি খাচ্ছে কুড়ে কুড়ে!

অতঃপর বুঝলামঃ
নিক্ষেপ মানে লক্ষ্য, অাকাশ মানে `স্বপ্ন’ অার মাটি মানে গন্তব্য।
কখনো এ জীবন নিজেই স্বপ্ন দেখে বিষাদের গন্তব্যে
কখনো বিষাদ স্বপ্ন দেখে, গন্তব্য খোঁজে জীবন
তেমনি কখনো কখনো লক্ষ্যই হয়ে ওঠে অারেক জীবন!
এসবের পর অনেক ভেবে অামি `জীবনবিষাদ’ ও `বিষাদজীবন’ এ দু’টি নাম সংগ্রহ করেছি মহাকালের প্রতিটি পাতা তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করে অাজ।
অার তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে যেন কেউ!
সে কেউ হয়তো অামি, কোনো মানুষ নয়তো কেউ কোনো!

বিষাদকাব্য-৫

মনে করি, এক নদী
নদীর ওপর জীবন
জীবনের ভরে সে নদী কতোই বা প্রবহমান হবে!
মনে করি, এক জীবন
জীবনের ওপর বিষাদ
তেমনি বিষাদের ভরে সে জীবনও কতোদূরই বা এগুবে!
কিন্তু যদি হয়
নদীর ওপর জীবন নয়
জীবনের ওপরও বিষাদ নয়
তবে নদী তার অাপন গতিতে চলবে…
অনুরূপ জীবন।
এ সূত্র মেনেই অাজ অামাদের এগিয়ে যাওয়া উচিৎ
দূরে, দূরে…
অামি জানি, দূর মানেই গন্তব্য,
সুদূর নিকট!

বিষাদকাব্য-৬

প্রত্যেক জীবনের প্রগাঢ়তর সুগহীন কক্ষে যে থাকে তার নাম `বিষাদ’!
নিয়তি মেনেই তার সঙ্গে নিত্য বসবাস অামাদের-
অামরাও তাই এক মনুষ্য বিষাদ!

বিষাদ মানে কি যেন এক শূণ্যতা!
শূণ্য থেকে শূণ্যতর হতে হতে যে শূণ্যতা নিজেই অাজ শূণ্যতার শূণ্যতায় নিমজ্জিত
অামি জানি, সে শূণ্যতায় বিষাদ!
শূণ্যতা পরিপূর্ণতার পরিপূরক বলে শূণ্যতা কখনো কখনো ভালো
শূণ্যতা কখনো কখনো অামার কাছে তাই অাশীর্বাদপুষ্ট জন্মের মতোই।
শূণ্যতাকে অামরা বিষাদ ভেবে থাকি, শূণ্যতা থেকেই ভাবি বিষাদের উদ্ভব
কেননা শূণ্যতা বিষাদেরই অারেক নামান্তর, অারেক উত্তরাধিকার!
কিন্তু অামার কাছে বিষাদ মানেই এক প্রগাঢ় শূণ্যতা!
শূণ্য থেকে যে `তা’ এ জন্ম থেকেই অাজও রয়ে গেলো শূণ্যতায়…

বিষাদকাব্য-৭

প্রতিদিনই মেডিক্যাল হাসপাতালের বাইরে বসে থাকি অামি
অার অামার মাথার ওপর বসে থাকে নাম না জানা কি এক গাছ যেন!
নিশ্চুপ হয়ে কি জানি কি যেন ভাবি!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সেদিন ভাবলাম অার বুঝলামঃ
হাসপাতালের জন্ম কি জন্য; মানুষ বাঁচাতে এখানে অাসতে হয় অাবার মানুষ মারতেও তো এখানে অাসতে হয়!
অতঃপর শুনলাম,
মানুষের অাহাজারি…
কার যেন মৃত্যু হয়েছে অার মৃত্যুশোকে তাদের এ অশ্রুশোক!
মৃত্যুশোকে তাদের চোখে নোনতা জল!
কিন্তু এ কোনো বিষাদ নয়,
মায়াত্যাগী অশ্রু!
অামি জানি, বিষাদ মানে সে তো কান্নার অারও বিস্তৃত স্বর…
যে কান্না সকলে শোনে না, ভেতর `মানুষ’ শোনে
অার ভেতর জানে কতো উচ্চ সে কান্নার স্বর!

শেষমেশ এভাবেই বুঝেছি অামি,
বিষাদ মানে নিঃশব্দহীন গোপন কান্না অার প্রকাশ্য যে কান্না তার নাম অশ্রু!