বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ হাতে লিখেছেন আনিসুর

সন্ধ্যার আগে আগে ছাত্রছাত্রীরা বাড়ির পথ ধরল। আনিসুর রহমানও কথা বলার ফুরসত পেলেন। তবে আলাপ শুরুর আগেই, ঝোলা থেকে বের করলেন প্রসপেক্টাস, ছবি…আরও কত–কী। এগুলোর কোনোটার নকশা করেছেন তিনি, কোনোটায় এঁকেছেন ছবি। চমকে দেওয়ার মতো ব্যাপার হলো, আনিসুর রহমান বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষা বর্ণমালা ৮০০-এর বেশি ধরনে (ফন্ট) লিখতে পারেন। তাঁর নেশা-পেশা দুই-ই এখন ক্যালিগ্রাফি, শিল্পিত হস্তাক্ষর।

ধানমন্ডির স্ট্যামফোর্ড স্কুলে বসে ২৪ নভেম্বর কথা হচ্ছিল আনিসুর রহমানের সঙ্গে। শুক্র ও শনিবার এই স্কুলে আসেন তিনি। তাঁর কাছে ছোট ছেলেমেয়েরা হাতের লেখা শিখতে আসে। ক্লাসে শুধু শিশুদের দেখা গেলেও আনিসুর বললেন, ‘আমার কাছে অনেক পেশাজীবীও আসেন লেখা সুন্দর করতে। আছেন কিছু চিকিৎসক, প্রকৌশলীও।’ অনেকে নাকি বিসিএস পরীক্ষায় বসার আগে হাতের লেখাটা ঝালিয়ে নিতে হাজির হন আনিসুর রহমানের কাছে।

এসব কিছুর ফাঁকে তিনি যে কাজটি করেছেন সেটা জেনে বিস্ময় জাগল। আনিসুর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি হাতেই লিখে ফেলেছেন গুটি গুটি অক্ষরে।

অসমাপ্ত গল্প
সেদিন আলাপ জমল অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই লেখার গল্প ধরেই। আড়াই বছর আগে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন আনিসুর রহমান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখলেন। পুরো জাদুঘর ঘুরে মনটা বেশ আর্দ্র হলো তাঁর। মনে মনে ভাবলেন, জাতির জনকের প্রতি সম্মান দেখাবেন তিনি।

কিন্তু কীভাবে? উপায় পেয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনেই বই বিক্রয়কেন্দ্র। সেখান থেকেই কিনে নিলেন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। পড়তে শুরু করে জানলেন, বঙ্গবন্ধু বইটি হাতে লিখতে শুরু করেছিলেন। আনিসুর রহমান পরিকল্পনা করলেন, যেহেতু হাতের লেখাই তাঁর পুঁজি, তিনি বইটা হাতে লিখবেন।

টানা দুই বছর ধরে চলল আনিসুরের সেই চেষ্টা। সফলও হলেন। ঠিক যেমনভাবে চেয়েছিলেন তেমনভাবেই শেষ হলো বইটি। ঠিক যে শব্দ দিয়ে মূল বইয়ের যে পৃষ্ঠা শুরু হয়েছে, আনিসুরের হাতে লেখা বইতেও তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বইয়ের ভেতরের কিছু কিছু পৃষ্ঠায় নিজেই এঁকেছেন বঙ্গবন্ধুর ছবিও।

কখনো মূল বইয়ের সঙ্গে পৃষ্ঠা ওলটপালট হয়নি? আনিসুর বলেন, ‘মাঝেমধ্যে একটা শব্দের জন্য টানা ৩২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বাদ দিতে হয়েছে। তখন আবার নতুন করে লিখতে হয়েছে।’

আনিসুরের হাতে লেখা বইটি যিনিই দেখেছেন, তিনিই বইটি চেয়েছেন নিজের সংগ্রহে রাখবেন বলে। অনেকে নাকি বড় অঙ্কের সম্মানীও দিতে চেয়েছেন। আনিসুর রাজি হননি। বললেন, ‘বইটি আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিতে চাই।’

ইচ্ছা পূরণের জন্য বেশ কিছুদিন প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটা চিঠি নিয়েও ঘুরছেন তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ফটকে পৌঁছালেও তাঁর হাতে গিয়ে সে চিঠি পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে যত দিন না তিনি বইটি হস্তান্তর করতে পারছেন, তত দিন তিনি অপেক্ষা করে যাবেন বলে জানালেন।

বাবার কাছে হাতেখড়ি

আনিসুর রহমানের বাড়ি পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলায়। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন তাঁর বাবা মো. নাসিরউদ্দীন। তিনি ছাত্র পড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন ঠিকই, তবে মনের খোরাক মিটত না। মনের খোরাক মেটাতে পাথরের ওপর অক্ষর খোদাই করতেন আনিসুরের বাবা, শৌখিন নকশাও করতেন কখনো। হাতের লেখাও নাকি ছিল ভারি চমৎকার।

আনিসুর রহমান স্মৃতি থেকে বলেন, ‘তখন আমার বয়স বছর পাঁচেক হবে। একদিন বাবা বললেন তাঁর মতো করে “অ” লিখতে। আমি “অ” লিখলাম। সেই “অ” অবিকল বাবার হাতের লেখার মতোই হয়েছিল।’ এ দেখে তো মো. নাসিরউদ্দীনের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। তিনি গ্রামের এ-মাথা ও-মাথা স্লেট নিয়ে ছুটতে লাগলেন আনিসুরের লেখা দেখাতে।

বাবার সে কাণ্ড নাকি খুব উৎসাহ জুগিয়েছে। গল্পে গল্পে জানা গেল আনিসুরের শুরু হাতেখড়ির দিন থেকেই। এরপর বাবার মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন, সেখানেও চলল হাতের লেখা দিয়ে জাদু দেখানোর কাজ। তিনি মাদ্রাসার সব শিক্ষকের হাতের লেখা অনুকরণ করতে শুরু করলেন। বাদ যায়নি সহপাঠীদের লেখাও।

একসময় স্বরূপকাঠি ছেড়ে ঢাকায় থিতু হোন। ঢাকার একটি মাদ্রাসা থেকেই কামিল (স্নাতকোত্তর) পাস করেন। তখনো টুকটাক টিউশনি করে দিন চালান। বিষয় সেই একই। ছাত্রছাত্রীর হাতের লেখা খারাপ, ভালো করে দিতে হবে।

এক স্কুলের ১৯ শাখা

স্নাতকোত্তর পাসের পর বিপত্তিতে পড়লেন আনিসুর। পেশা হিসেবে কোনো কাজই তাঁকে টানে না। দ্বিধায় কাটতে থাকল দিন। এমনই একদিন প্রত্যয়ী হয়ে উঠলেন তিনি। ভাবলেন, যা আছে কপালে! হাতের লেখা শেখানোর কাজই তিনি করবেন।

২০০৬ সালের কথা, ফার্মগেটে একটা ঘর ভাড়া নিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে, স্কুলে স্কুলে প্রচারপত্র বিলিয়ে হাতের লেখা শেখানোর প্রচার শুরু করলেন। চার-পাঁচজনের বেশি ছাত্র জুটল না। আনিসুর ঠিক করলেন চার-পাঁচজনকে নিয়েই কাজ শুরু করবেন।

জনপ্রতি মাসিক ৪০০ টাকা ফি নিতেন শুরুতে। তত দিনে বিয়ে করেছেন, কিন্তু স্ত্রীকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারছেন না অর্থের অভাবে। আনিসুর তবু হাল ছাড়লেন না। দিনের বেলা ক্লাস নেন, রাতে চালান প্রচারণা। দেয়াললিখনে পারদর্শী ছিলেন, নিজের বিজ্ঞাপন দিতেন দেয়ালে দেয়ালে।

এত অনিশ্চয়তার মধ্যেও এগিয়ে চলল আনিসুরের সুন্দর হাতের লেখা শেখানোর স্কুল। কোনো কোনো মাসে খুব টানাটানি পড়ে যেত। তখন ছোট ভাইয়ের কাছে হাত পাততেন। ছোট ভাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। বাড়ি থেকে তিনি হাতখরচা পেতেন। একজনের হাতখরচায় দুজন মিলে চলতেন।

আনিসুর বললেন, ‘কষ্ট করেছি কিন্তু বাড়ি থেকে টাকাপয়সা চাইনি। বাবার সমর্থন নিলে হয়তো স্কুলটাকে দাঁড় করানোর তাড়া থাকত না। কাজটা এগোল ঢিলেঢালা।’

দিন ফিরেছে আনিসুরের। তাঁর স্বপ্ন অনেকখানি পূরণ হয়েছে। ঢাকায় এখন তাঁর হাতের লেখা স্কুলের শাখা ১৯টি। একা কুলিয়ে উঠতে পারেন না বলে গ্রাম থেকে বড় ভাইকে এনেছেন। ছোট ভাইটি বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনিও দেখভাল করেন। তিন ভাইয়ের প্রচেষ্টায় চলছে হাতের সুন্দর লেখা শেখানোর কাজ। সূত্র : প্রথম আলো