বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি চিঠি

আনিসুল হক : প্রিয় বঙ্গবন্ধু, আপনি তখন কী ভাবছিলেন? ইতিহাস ইতিহাসের মতো বড় বড় ঘটনার বর্ণনা দেয়, সংবাদমাধ্যম বলতে পারে বাইরে কোথায় কখন কারা কী ঘটাচ্ছিল এবং কেন ঘটাচ্ছিল, কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে কী ঘটে, মানুষটা তখন কী ভাবছিল, সেটা কল্পনা করেন কেবল সাহিত্যিকেরা; আমিও তো একজন লেখক; হাজার হাজার পৃষ্ঠা ইতিহাসে যা লেখা নেই, সেই কথাটা আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ভোরে আপনার মনের মধ্যে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, নাকি আপনি শান্তভাবে ধীরস্থিরভাবে প্রত্যক্ষ করছিলেন আপনার মানুষদের চরমতম বিশ্বাসঘাতকতা আর নিষ্ঠুরতা?

আপনার সবচেয়ে বড় গুণ কী? বিদেশি সাংবাদিকের করা এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি বলেছিলেন, ‘এই দেশের মানুষকে আমি খুব ভালোবাসি।’ আপনার বড় দোষ কী, সেই প্রশ্নের উত্তরেও আপনি বলেছিলেন, ‘এই দেশের মানুষকে আমি বড় বেশি ভালোবাসি।’ এই দেশের এবং এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য নিজের জীবন আপনি উৎসর্গ করে দিয়েই রেখেছিলেন। এই দেশের মানুষের জন্য মরতে আপনি সব সময়ই প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৪৭-এ যখন ইংরেজরা চলে যাচ্ছে, তার আগে আপনি আপনার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর শরত্চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কিছুদিন স্বাধীন বৃহত্তর বাংলার জন্য আন্দোলন করেছিলেন, সেই আন্দোলন হালে পানি পায়নি, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজউদ্দৌলা হোস্টেলে ছাত্রদের ডেকে আপনি বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা স্বাধীনতা নয়, ঢাকায় যেতে হবে, প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করতে হবে।

১৯৪৮ সাল থেকেই আপনি শুরু করেন সংগ্রাম, প্রথমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য, ১৯৪৮ সালেই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার বরণ করতে হলো আপনাকে। তারপর কতবার কারাগারে গেছেন। কারাগারে স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা আপনার সাক্ষাৎকার নিত, তারা বলত আপনাকে, বন্ডসই দিন, মুক্তি নিন, আপনি বারবার বলতেন, আপনার জীবন গেলে যাবে, কিন্তু বন্ডসই দিয়ে মুক্তি আপনি নেবেন না, এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আপনি জীবন দিতে প্রস্তুত আছেন, আর বলতেন, এই দেশের মানুষের মুক্তি আসবেই। সেসব কথা গোয়েন্দারা রিপোর্ট করত, সরকারি হেফাজতখানায় সেই সব রিপোর্ট রয়ে গেছে, এখন সেসব বিবরণ আমরা পাঠ করতে পারি, আর বিস্মিত হই, কী ভীষণ প্রতিজ্ঞা, সাহস, একাগ্রতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম আর আত্মত্যাগের বাসনা সেই তরুণ বয়স থেকেই ধারণ করতেন আপনি! আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলো, আর তার সংগঠন গড়ে তোলার কাজে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন আপনি, কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করতেন। ওই সময় থেকেই আপনি হয়ে উঠেছিলেন পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।

১৯৫০ সালে আপনার বয়স ছিল মাত্র ৩০। ঢাকার আরমানিটোলায় জনসভা। আওয়ামী মুসলিম লীগের। তাতে ভাষণ দেবেন মাওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান, শামসুল হক। কিন্তু জনতা চিত্কার করছে, ‘শেখ মুজিব’ ‘শেখ মুজিব’ বলে। তারা শেখ মুজিবের ভাষণই শুনতে এসেছে। ভাসানী ঘোষণা দিলেন, আপনারা মুজিবুরের ভাষণ শুনতে চান, এইবার ভাষণ দেবেন শেখ মুজিবুর। আপনি বক্তৃতায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক আর মুসলিম লীগের অপশাসন-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, বলতেন বাংলার মানুষের মুক্তির কথা। আপনাকে বারবার গ্রেপ্তার করা হতো। কিন্তু তাতে আপনাকে টলানো যেত না। এক জেলার কারাগার থেকে আরেক জেলার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হতো। জামিন হলে আপনি মুক্তি পাবেন। জেলগেটে মানুষ ভিড় করত আপনাকে বরণ করার জন্য, আপনার কথা শোনার জন্য। জেল থেকে বেরিয়েই আপনি আবার শাসকদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতেন। আপনাকে আবার গ্রেপ্তার করে আরেক জেলে পাঠানো হতো। সেখান থেকে বেরিয়েও আপনি জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন। কারাগার থেকে কারাগারে কেটে যেত আপনার জীবন। তাই তো একদিন আপনার ছেলে শেখ কামাল তার বোনকে আধো আধো গলায় বলেছিল, ‘হাছু আপা, তোমার আব্বাকে আব্বা বলে ডাকি?’ জন্মের পর সে তো আব্বাকে দেখেনি। আপনি তো জেলে জেলেই কাটিয়ে দিয়েছেন বেশির ভাগ সময়।

আর ছিলেন এক অসাধারণ নারী। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ওরফে রেনু। আপনি তো রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, কারাগার থেকে কারাগারে জীবন কাটাচ্ছেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সংসারের বোঝা টানছেন রেনু। দেশের জন্য আপনাকে উত্সর্গই করে দিয়েছেন তিনি। এমনও হয়েছে, আগের দিন আপনি মন্ত্রী, পরের দিন মন্ত্রিসভা বাতিল, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেগম মুজিব পথে পথে ঘুরছেন, কেউ বাসা ভাড়া দিতে সাহস পাচ্ছে না।

একটাই স্বপ্ন ছিল আপনার। এই দেশের মানুষের মুক্তি। একটাই লক্ষ্য ছিল আপনার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আপনি কখনো পূর্ব পাকিস্তান কথাটা মুখে উচ্চারণ করতে চাইতেন না। আপনি বলতেন বাংলা, পূর্ব বাংলা। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আপনি বলেছিলেন, ‘স্যার, আপনি দেখবেন, ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি করেছি, আপনারা এটাকে বাংলা বলে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে ঐতিহ্য।’

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুদিবসে আলোচনা সভায় আপনি বলেন, ‘একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্র হইতে “বাংলা” কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র “বঙ্গোপসাগর” ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে “বাংলা” কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।…আমি ঘোষণা করিতেছি—আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে শুধুমাত্র “বাংলাদেশ”।’

বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে, এই চিন্তা আপনাকে ঘুমাতে দিত না। কবে থেকে এই স্বপ্ন আপনি দেখেছিলেন? অন্নদাশঙ্কর রায় এ প্রশ্ন আপনাকে করেছিলেন। আপনি জবাব দিয়েছিলেন, সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। যখন সোহরাওয়ার্দী আর শরৎবাবুর বৃহত্তর বাংলার আন্দোলন ব্যর্থ হলো, তখন থেকে। ১৯৬৩ সালের দিকে, যখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চলছে, আপনি চলে গিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাহলে ভারত সরকার বাংলাদেশকে কতটা সাহায্য করতে পারবে।

ছয় দফা দাবিও দিয়েছিলেন আস্তে আস্তে চূড়ান্ত স্বাধীনতার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে আপনি একটা জনসভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। এক পাকিস্তানি সাংবাদিক উঠে পড়ে আপনার গাড়িতে। আপনি তাকে বলেন, আপনার লক্ষ্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। একবার নির্বাচন হয়ে যাক, আপনি এলএফও (লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার, যাতে বলা ছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অনুমোদন ছাড়া সংবিধান প্রণয়ন করা যাবে না) ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে বাতাসে উড়িয়ে দেবেন। ১৯৭০ সালের জুন মাসে ঢাকার ভারপ্রাপ্ত মার্কিন কনসাল অ্যান্ড্রু কিলগোরকেও আপনি বলেছিলেন, ‘…আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করব। সেনাবাহিনী বাধা দিলে শুরু করব গেরিলাযুদ্ধ।’

নিজের জীবনের মায়া আপনি কোনো দিনও করেননি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় আপনাকে পেছন থেকে গুলি করে মারার চক্রান্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে যখন আপনি বন্দী, তখনো আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পরিকল্পনা হচ্ছিল। আপনার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। আপনি বলেছিলেন, আপনি মৃত্যুকে ভয় পান না, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আপনি বলে যাবেন, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, আমাকে ফাঁসি দাও দুঃখ নাই, শুধু আমার লাশটা বাংলার মাটিতে পৌঁছে দিও।’

মানুষকে আপনি ভালোবাসতেন। মানুষও আপনাকে খুব ভালোবাসত। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে এক বৃদ্ধা আপনার জন্য কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন, আপনাকে দেখে হাত ধরে বলেছিলেন, ‘বাবা, আমার এই কুঁড়েঘরে তোমাকে একটু বসতে হবে।’ তিনি আপনাকে দুধ খেতে দিলেন, আর দিলেন চার আনা পয়সা, বললেন, ‘খাও বাবা, আর এই পয়সা কটা নাও, আমার তো আর কিছু নাই।’ আপনি নীরবে চোখের জল ফেলেছিলেন, আর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘মানুষকে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’

মানুষকে ধোঁকা আপনি দেননি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রকাশ্যে শপথ করিয়েছিলেন, কেউ যেন ধোঁকা না দেয়। আপনি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাননি। চেয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নিজের জীবনের সমস্ত সাধনা-আরাধনা-পরিশ্রম-প্রতিজ্ঞা-আত্মদান আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে আপনি স্বাধীন করতে পেরেছিলেন।

১৯৭৫ সালের সেই ভোরে কি বৃষ্টি হয়েছিল? খুব ভোরবেলা টেলিফোনের শব্দে আপনার ঘুম ভাঙে, আপনি শুনতে পান আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা হয়েছে, গোলাগুলি হচ্ছে। আপনি টেলিফোন করছিলেন পুলিশকে। কিন্তু আপনার বাড়িতেও যে হামলা হতে পারে, সেটা তো আপনি কোনো দিনও ভাবেননি। ভারত আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিল, বিশেষ প্রতিনিধি আপনার বাড়িতে এসে আপনাকে খবর দিয়েছিল, আমেরিকানরাও সাবধান করে দিয়েছিল। আপনি বলেছিলেন, আপনার মানুষ কোনো দিনও আপনার ক্ষতি করবে না। পাকিস্তানি জেনারেলরা সাহস পায়নি আপনার গায়ে হাত তোলার, বাঙালিরা কোত্থেকে পাবে?

কিন্তু আপনি যখন দেখলেন, আপনার বাড়িতেও আক্রমণ করা হয়েছে, বাইরে গোলাগুলি হচ্ছে, তখন কী ভাবছিলেন আপনি? যখন দেখলেন, শেখ কামালের বুলেটবিদ্ধ শরীর থেকে রক্তের ধারা বইছে, তখন এই বাঙালিদের ওপর থেকে আপনার আস্থা কি টলে যাচ্ছিল? না। কারণ, আপনি পুলিশকে বলেছিলেন, পাল্টা গুলি করা বন্ধ করো। গুলি বন্ধ হলো। খুনিরা ঢুকে গেল বাড়িতে। আপনি সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। পরনে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, হাতে পাইপ আর দেশলাই। ‘তোরা কী চাস?’ আপনার এই প্রশ্নের জবাবে ওরা যখন গুলি করল, তখনো কি বাঙালিদের ওপর থেকে আপনি আস্থা হারাননি?

আর বেগম মুজিব! যিনি ১৯৬৯ সালে আপনি যখন বন্দী, আপনাকে নিষেধ করেছিলেন প্যারোলে মুক্তি নিতে, যিনি ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ বিকেলে আপনাকে বলেছিলেন, নিজের বিবেকের কথা ঘোষণা দিতে, যিনি মার্চের আলোচনার সময় বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হয়ো না, তাহলে মানুষ তোমার সঙ্গে আর থাকবে না, তখন ইয়াহিয়া তোমাকে মারতে পারবে, আর মানুষ যদি তোমার সঙ্গে থাকে, তাহলে তোমার কোনো ক্ষতিই ওরা করতে পারবে না।’ যিনি আজীবন নিজে কষ্ট করে আপনাকে উৎসর্গ করে রেখেছিলেন দেশের জন্য, তিনি যখন দেখলেন, আপনার বিশাল মহিরুহ দেহটা পড়ে আছে সিঁড়িতে, তার কী মনে হয়েছিল? রাসেল যখন বাড়ির লোক আর পুলিশদের বলছিল, ‘আমাকেও কি ওরা মেরে ফেলবে? আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও,’ খুনিরা বলল, চল, তোকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিই…একে একে সবাই গেল, সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, তার স্ত্রী…।

গুলিবিদ্ধ হয়ে সিঁড়িতে পড়ে যেতে যেতে নিশ্চয়ই আপনি বলেছিলেন, ওরা বাংলার মানুষ, ওরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না, বলেছিলেন, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ…আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। বলেছিলেন, ‘এই দেশের মানুষের কাছে আমার ঋণ ছিল, তারা আমাকে খুব ভালোবাসত, আমার রক্ত দিয়ে যদি সেই ঋণ কিছুটা শোধ হয়, তবে তাই হোক…।’

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক