বাদীই বিকৃত মানসিকতার, একটি মহলের ইন্ধনে মামলা

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষে ছাপানো আমন্ত্রণপত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিকৃত ছবি ছাপানো হয়েছে অভিযোগ করে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেই মামলার বাদী বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও নগর আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ সাজুর মানসিকতাকেই বিকৃত বলেছেন বিবাদী ইউএনও গাজী তারিক সালমন।

গত বুধবার আদালতে দেওয়া জামিন আবেদনে নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করে ও এর পক্ষে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেন ইউএনও। লিখিত আবেদনে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি ‘বিকৃতভাবে’, ‘শ্রদ্ধা-সম্মান না দেখিয়ে’ কিংবা ‘অসম্মান করে’ প্রকাশ করার যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা পুরোপুরি বানোয়াট, মিথ্যা এবং অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

গাজী তারিক সালমন বর্তমানে বরগুনা সদর উপজেলার ইউএনও। আগে বরিশালের আগৈলঝাড়ার ইউএনও ছিলেন।

তারিক সালমন বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৮তম জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস ২০১৭ উপলক্ষে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই শিশুর ছবি ব্যবহার করে ওই আমন্ত্রণপত্রের নকশা করা হয়েছিল। আমন্ত্রণপত্রের প্রচ্ছদে প্রতিযোগিতায় ‘গ’ গ্রুপে প্রথম পুরস্কার পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্রের একটি ছবি ব্যবহার করা হয়। এর শেষ প্রচ্ছদ বা ব্যাক কভার হিসেবে ব্যবহার করা হয় ‘খ’ গ্রুপের দ্বিতীয় স্থান পাওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। হুবহু বিজয়ী শিশুর আঁকা ছবিই আমন্ত্রণপত্রে ব্যবহার করা হয়েছে উল্লেখ করে ইউএনও বলেন, ‘কার্ডে জাতির জনকের ছবি ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করার অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য ও বিদ্বেষপ্রসূত।’

শিশুদের আঁকা ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন জাতীয় দিবসের আমন্ত্রণপত্র তৈরি করাকে বহুল প্রচলিত রীতি উল্লেখ করে তারিক বলেন, শিশুদের আঁকা ছবি ব্যবহার করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক বিভিন্ন জাতীয় দিবসের আমন্ত্রণপত্র তৈরি করা হয়। তাদের সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ও সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিতেই মূলত এটি করা হয়। আগৈলঝাড়া উপজেলার স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আমন্ত্রণপত্রটিও সেই উদ্দেশেই তৈরি করা হয়েছিল। এমনকি আমন্ত্রণপত্রে ব্যবহার করা ছবি দুটিতে আঁকিয়ে দুই শিশুর নামও উল্লেখ আছে বলে জানান তিনি।

ফলে ছবি দুটি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ নেই বলে আবেদনে উল্লেখ করেন ইউএনও। তিনি বলেন, ‘‘আগৈলঝাড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর আঁকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিকে ‘বিকৃত’ হিসেবে অভিহিত করে বাদী নিজেই বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।”

আবেদনে আরো জানানো হয়, প্রথমে আমন্ত্রণপত্র ছাপার পর শেষ প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি বেমানান মনে হওয়ায় আমন্ত্রণপত্রটি সংশোধন করা হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি প্রথম প্রচ্ছদে ও মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্রের ছবিটি শেষ প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়। এই আমন্ত্রণপত্র নিয়ে যেন কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয় সেজন্যই এটি দ্বিতীয়বার ছাপিয়ে দ্রুত বিতরণ করা হয় বলেও জানান ইউএনও।

মামলার আরজিতে বাদী অভিযোগ করেন, ইউএনও গাজী তারিক সালমন আগেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। এই অভিযোগ মিথ্যা বলেও নিজের আবেদনে উল্লেখ করেছেন ইউএনও।

আবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে কেন মামলা করা হয়েছে সে সম্পর্কে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন তারিক সালমন। ২৬ মার্চ অনুষ্ঠানের দুই মাসের বেশি সময় পর স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে কেন অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে মামলা করা হয়েছে- সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আগৈলঝাড়া উপজেলায় ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে ২৪ মে ২০১৭ কর্মকালীন প্রায় আট মাস সময়ে বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম তদারকি, পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে নকল ও অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান, সরকারি জমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন, মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং ক্ষমতাশালী দুর্নীতিবাজদের পার্সেন্টেজ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণে সংক্ষুব্ধ একটি মহলের ইন্ধনে আমাকে হয়রানি করার জন্য এসব বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’

ওই আমন্ত্রণপত্রে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করার জন্য কিছু করা হয়নি উল্লেখ করে তারিক সালমন বলেন, ‘আগৈলঝাড়া উপজেলার মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, ২০১৭-এর আমন্ত্রণপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে কোনোরূপ বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়ে থাকলে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক মামলায় দায় হতে অব্যাহতি প্রার্থনা করছি।’

মামলার বাদী বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ সাজু জানান, আগৈলঝাড়ায় ইউএনওর দায়িত্ব পালনকালে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষে ছাপানো নিমন্ত্রণপত্রের পেছনের পাতায় বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ছবি ছিল। বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ছবি দেখে মর্মাহত হয়ে তিনি গত ৭ জুন পাঁচ কোটি টাকার মানহানির অভিযোগে বরিশালের আদালতে মামলা করেন।

ওই মামলায় বিবাদী ইউএনওকে সমন দেওয়া হয়। গতকাল জেলার মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম মো. আলী হোসাইনের আদালতে হাজির হন তিনি। আদালতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দেওয়ায় বেলা ১১টার দিকে ইউএনওকে সাময়িকভাবে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে দুপুর দেড়টার দিকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিলে ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় তাঁকে জামিন দেওয়া হয়।