বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

লাখো শহীদের রক্তে ভেজা আমার মাতৃভূমি, কত মা-বোনের আত্মত্যাগ আর নারী নির্যাতনের বিনিময়ে পাওয়া, কত নয়নের অশ্রু, কত আনন্দ-বেদনার রক্তকুসুমে গাঁথা বিজয়ের এই নির্মাল্যখানি। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয়। পাক হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে ভেঙে দিতে শুরু করে বর্বর গণহত্যা। গণহত্যার পাশাপাশি শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় হানাদাররা বাহিনী। বাংলাদেশ পরিণত হয় ধ্বংস স্তুপে। আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অদম্য সাহস ও জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুব, নারীসহ সব শ্রেণী-পেশার সর্বস্তরের বাঙালি। চলছে মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। দেশব্যাপী মহোৎসবে উদযাপিত হবে এই দিনটি। অনেক ত্যাগ সংগ্রাম নারীর সম্ভ্রমহানি আর রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। এই দেশ নিয়ে আমাদের অনেক প্রত্যাশা হাজারো স্বপ্ন।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ এতটাই আর্থিকভাবে দুর্বল ছিল, মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদ হেনরি কিসিঞ্জার এই দেশকে একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের সেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন, অজপাড়া গ্রামের গরিব-দুঃখী মানুষও। ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফে মতামতধর্মী এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশটির জিডিপি ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, নতুন ভিত্তিবছরের হিসাবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩২৭ ডলার। ডলারের বর্তমান বাজার অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে ২৯ হাজার ৪৩০ টাকা।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে এখন বলা হয় উন্নয়নের রোল মডেল, বলা হয় এশিয়ার অন্যতম একটি দেশ। বিদেশিরা বাংলাদেশের প্রশংসা করছেন। প্রশংসা করছে জাতিসংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। কেউ এখন আর না খেয়ে থাকছে না। একাত্তরের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ এক নয়। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দেশের বিদ্যুৎ সংকট সিংহভাগই কেটে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান সরকার দেশের ইপ্সিত প্রবৃদ্ধির ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রাপ্তির হারও অনেক বেড়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বাজেটে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক ভালো। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকস্তিান, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারকে পেছনে ফেলেছে বিশ্ব সুখী দেশের তালকিায় এগিয়ে বাংলাদশে। ২০২১ সালের নতুন এই সূচকে গত বছররে তুলনায় ছয় ধাপ এগয়িছেে বাংলাদশে। যার অবস্থান এখন ১০১তম। ২০২১ সালরে এই তালকিায় বাংলাদশে পেয়েছে ৫.০২৫ পয়ন্টে। এর আগে, ২০২০ সালে ৪.৮৩৩ এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশের দখলে ছিল ৪.৪৫৬ পয়েন্ট। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ক্রীড়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে ‘ভিশন ২০২১’ ও ‘ভিশন ২০৪১’ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার, যা সফল হওয়ার পথ আর বেশ দূর নয়। শুধু দেশেই নয়-আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর স্বীকৃতি মিলেছে। আমাদের এই মহান অর্জন ধরে রাখতে হবে।

বর্তমান সরকার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ বাস্তবায়ন করতে ব্যাপক হারে কাজ করে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারত। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি বড় বাধা। দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিতে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের বেতন দ্বিগুণ করেও কোনো ভালো ফল হচ্ছে না। দুদকের বর্তমান তৎপরতার মাধ্যমে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা অনেক কঠিন কাজ। এ জন্য সরকারকে জিরোট্ররালেন্স, কার্যকর পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাশালী ও গর্বিত সোনার বাংলাদেশ।

বর্তমান বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লক্ষের অধকি শ্রমিক কাজ করছে। স্বল্প সুদে অভিবাসন ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করে দেশের ৭টি বিভাগীয় শহরে এর শাখা স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্যাংকরে মাধ্যমে এপ্রলি ২০১৪ র্পযন্ত ২০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা অভিবাসন ঋণ বিতরণ করা হয়। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারাদেশে তৃণমূল র্পযায় থেকে বিদেশে গমনেচ্ছুক জনগণকে রেজিষ্ট্রেশন করা হয়েছে ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকেও এসব গ্রহণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে হয়রানি ছাড়াই স্বল্প ব্যয়ে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলোতে শ্রমকিগণ যেতে পেরেছে। বাংলা নববর্ষে উৎসব ভাতা, আশ্রয়ণ, একটি বাড়ি একটি খামার, দুস্থ ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অসংখ্য সেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার ৭১ শতাংশ। সড়ক, নৌ, রেল ও বিমানসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন বাংলাদেশে এখন দৃশ্যমান সত্য। রাজধানীতে বেশ কটি ফ্লাইওভার হয়েছে, মেট্রোরেলের কাজ, পদ্মা সেতুর কাজ বর্তমানে সম্পন্ন। সরকার পাতাল রেল করারও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অনেক আশা তৈরি হচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে আসলেই মাতৃভূমি বাংলাদেশ উন্নতি হচ্ছে এবং বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারকে এইসব কাজ সম্পন্ন করতে হবে। বাংলার মানুষকে উপহার দিতে হবে সুখী সমৃদ্ধ একটি দেশ ও সুখী একটি জীবন। বাঙালির বিজয় মাসে এই হোক আমাদের সমবেত অঙ্গীকার।