বিদেশি সাংবাদিকের চোখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশা

মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর কবল থেকে রক্ষা পেতে গত ৪ সপ্তাহে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে। জনবহুল বাংলাদেশের জন্য এত বিপুল পরিমাণ মানুষকে আশ্রয় দেয়া কঠিন হলেও শুধুমাত্র মানবিকতার কারণে তা করেছে শেখ হাসিনা সরকার।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারকে এমন দমন পীড়ন বন্ধে আহ্বান জানালেও কার্যত তা কানে নেয়নি সু চি সরকার। উল্টো বিতারিত করা সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ নোবেল জয়ী তথাকথিত এই গণতন্ত্র পন্থী নেত্রী।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের অতিরিক্ত চাপের কারণে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে এখন উপচে পড়া ভীড়। যেখানে পর্যাপ্ত ত্রাণ মিললেও বিশুদ্ধ পাণীয় ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার দেখা দিয়েছে সংকট। এছাড়া যাদের শরণার্থী শিবিরগুলোতে জায়গা মেলেনি, তারাও শিবিরগুলোর আশপাশে বাস করছেন।

মার্কিন সংবাদসংস্থা এসোসিয়েট প্রেস এক প্রতিবেদনে শরণার্থী শিবিরের নানা সংকট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া শাখার প্রধান বার্নেট আর্মানগুয়ে নিজেই শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এসময় তার ক্যামেরায় উঠে এসেছে শরণার্থী শিবিরগুলোর নানা দিক।

বার্নেট আরব বসন্ত থেকে শুরু করে ২০১৫ সালে নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের বিপর্যয় স্বচক্ষে দেখেছেন। তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন তার ছবি ও লেখনীর মাধ্যমে। বিশ্বের সাম্প্রতিককালের এই বড় বিপর্যয়েও থেমে নেই তার ক্যামেরা। ছবির মাধ্যমে জানিয়েছেন সর্বহারা রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা।

শুধু শরণার্থী শিবিরই নয়, কক্সবাজারের সীমান্ত অঞ্চলে পৌঁছানোর পর বার্নেট রোহিঙ্গাদের আসার চিত্রও স্বচক্ষে দেখেছেন। প্রাণ বাঁচিয়ে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে আসা মানুষের চিত্রও ফুটে উঠেছে তার ক্যামেরার লেন্সে। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সবার কষ্টের যে চিত্র বার্নেটের ক্যামেরায় উঠে এসেছে তা এক কথায় অবর্ণনীয়।

১. ঘটনাস্থলে এসেই বার্নেট দেখেছেন প্রাণ ভয়ে ভীত মানুষদের পালিয়ে আসার দৃশ্য। তাদের কথা না বুঝলেও এপি’র এই সাংবাদিকের অনুধাবন করতে কষ্ট হয়নি, কেমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন। বিপদ সংকুল দীর্ঘ যাত্রার কারণে অর্ধ নগ্ন নারী, পুরুষ ও শিশুদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

২. নিরাপত্তা বাহিনীর নিধন অভিযানে মিয়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের কোনো গ্রামই আর টিকে নেই। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার সেই দৃশ্য এপি’র এই সাংবাদিকও প্রতক্ষ্য করেছেন। মিয়ানমারে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সীমান্তের বাংলাদেশ অংশেই দাঁড়িয়ে তা দেখেছেন। আর ক্যামেরার শক্তিশালী লেন্সের মাধ্যমে তুলে এনেছেন দূরের সেসব দৃশ্য।

৩. প্রথম দিকে বানের মতো আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল অচেনা পরিবেশ। তারা কোথায় থাকবে এবং খাবে এই বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি অনিশ্চয়তায় ছিল রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ। সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে বিদেশি একটি দেশে তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হবে তা নিয়েও শঙ্কার শেষ ছিল না। কিন্তু বন্ধুপ্রতীম বাংলাদেশের জনগণ তাদের আপন করে নিয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মধ্যবয়স্ক এক রোহিঙ্গা নিজের গেঞ্জির মধ্যে বেশ কিছু খাবারের ব্যাগ জমিয়ে রেখেছেন। এবং সেগুলো রক্ষা করে আরও ত্রাণের আশায় চেয়ে রয়েছেন।

৪. মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আর বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের হাত থেকে বাঁচতে নারী, শিশু, বৃদ্ধ সবাই চলে এসেছেন বাংলাদেশে। বৃদ্ধদের শরীর এমন ধকল সহ্য করতে না পারলেও শুধু বেঁচে থাকার আশায় শেষ শ্বাসটুকু সম্বল করে প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশে। তাদের মুখের অভিব্যক্তিতেই ফুটে উঠেছে ক্লান্তিকর দীর্ঘ যাত্রার ছাপ। সঙ্গে রয়েছে স্বজন হারানোর বেদনা!

৫. কক্সবাজারের বেশ কিছু এলাকায় পরনের কাপড় পড়ে থাকতে দেখেছেন বার্নেট। সেগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের দেয়া। তবে রোহিঙ্গারা তা গ্রহণ না করায় এভাবে পড়ে রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি জেনেছেন, আসলে অধিকাংশ শরণার্থীর যত না বস্ত্রের প্রয়োজন তার থেকেও বেশি দরকার অষুধ, খাদ্য ও পানীয়। সেই সঙ্গে থাকার স্থান।

৬. রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা এক নারীর সঙ্গে ছিল ছবিটি। সেটি তার পরিবারের ছবি। ওই নারী বার্নেটকে বলছিলেন, এদের মধ্যে তার মেয়েও রয়েছে। এবং এখন পর্যন্ত সে বাংলাদেশে ঢুকতে পারেনি। বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানেন না। তার মতো এমন প্রশ্ন অনেক রোহিঙ্গার মনেই রয়েছে।

৭. দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদেরও রেহাই দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টাও যেন ব্যর্থ হয় সেজন্যে পথে পথে দেশটির সেনাবাহিনী ছড়িয়ে রেখেছে মৃত্যু ফাঁদ। প্রাণঘাতি ল্যান্ড মাইনে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। যারা বেঁচে যাচ্ছেন তাদের কারও হাত কিংবা পা উড়ে যাচ্ছে। তেমনই পা হারানো এক রোহিঙ্গা বৃদ্ধাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ছুটছেন তার স্বজনেরা।

৮. কক্সবাজারের একটি হাসপাতাল থেকে রোহিঙ্গা কিশোরের ছবিটি তোলেন এপি’র এই সাংবাদিক। মৃতপ্রায় ছেলেটির বাবা জানায়। পালিয়ে আসার সময় ছেলের বুকে গুলি চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ছেলেটির বাবা আরও জানায়, পালাতে থাকা মানুষের স্রোতের ভেতর গুলিবিদ্ধ ছেলেকে আনতে গিয়ে সে তার স্ত্রীকে হারিয়েছে। এখনও তার জানা নেই কি হয়েছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভাগ্যে।

৯. জাতিসংঘ শিশু অধিকার তহবিল ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই শিশু। এপি’র সাংবাদিক বার্নেট নিজেও দেখেছেন, কিভাবে স্রোতের মতো অনিশ্চিত যাত্রায় পরিবারের সঙ্গী হয়েছে রোহিঙ্গা জাতির পরবর্তী প্রজন্ম। ছবিটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বার্নেট নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত পরিস্থিতির স্মৃতিচারণ করেন। বলেন, সেটি ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু এটি মানুষের সৃষ্টি। যার পেছনে রয়েছে জাতিগত ঘৃণা আর কুৎসিত রাজনীতি।

বার্নেটের ক্যামেরায় বন্দি এসব খন্ডচিত্র বলে দিচ্ছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কি পরিমাণ বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।