বিমানের একটি ভুলের মাশুল সাড়ে চারশ কোটি টাকা!

মান ও কার্যক্ষমতা যাচাই না করে মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজে আনা হয় দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এর একটি গত ডিসেম্বর থেকে বিমানবন্দরে পড়ে আছে। ফলে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

চুক্তির শর্ত মোতাবেক ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত বাকি ২৮ মাস বসিয়ে রাখতে হলে লিজের শর্ত অনুযায়ী মাসিক প্রায় পাঁচ কোটি টাকা হিসেবে আরও ১৪০ কোটি টাকা গুনতে হবে বিমানকে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ভুলের মাশুল হিসেবে গুনতে হচ্ছে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এএম মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, আমরা বছরের শুরুতে বিকল হয়ে পড়ে থাকা উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের জন্য অর্ডার দিয়েছি। অর্ডারের ৬০ দিনের মধ্যে ইঞ্জিন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টেকনিক্যাল কারণে ওই কোম্পানি আট মাসেও ইঞ্জিন সরবরাহ করতে পারেনি।

তিনি বলেন, তবে অনেকদিন পর হলেও সানফ্রানসিসকো থেকে আমরা ইঞ্জিন দুটি পাচ্ছি। চলতি মাসের ২৩ বা ২৪ তারিখ ইঞ্জিন দুটি পাব বলে আশ্বাস দিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি।

নিম্নমানের উড়োজাহাজ লিজে আনার কারণ সম্পর্কে মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এ সময় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

জানা গেছে, ওই ঘটনায় দায়ীদের শনাক্ত করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। তদন্তে লিজ চুক্তির সব শর্তই বিমানের স্বার্থপরিপন্থী বলে প্রমাণ পেয়েছে কমিটি।

মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নিলুফার জেসমিন খান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়েছে, ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজে আনা দুটি উড়োজাহাজের একটি দীর্ঘদিন ধরে গ্রাউন্ডেড রয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধানে গঠিত সাব-কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখিত অনিয়মগুলো তদন্তে অতিরিক্ত সচিবকে (বিমান ও সিএ) আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

এছাড়া প্রয়োজনে অন্যান্য সংস্থার এক বা একাধিক সদস্যকে কো-অপ্ট করা বা প্রয়োজনীয় সহায়তা নেয়ারও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কমিটিকে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে থাকা ১৩টি উড়োজাহাজের মধ্যে সাতটি লিজে আনা। এগুলোর মধ্যে ইজিপ্ট এয়ার থেকে ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজ দুটির কারণে বিমানের ক্ষতির মুখে পড়া নিয়ে সম্প্রতি একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেয় বিমান। এর একটি বিমানের বহরে যুক্ত হয় ২০১৪ সালের মার্চে এবং অন্যটি একই বছরের মে মাসে। ওই দুটি উড়োজাহাজের যে কোনো একটি কোনো না কোনো সময় বিকল হয়ে বসে থাকে।

এক বছর ফ্লাইট পরিচালনার পর একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয় বাকি ইঞ্জিনটিও। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে আবারও ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। গত ডিসেম্বরে নষ্ট হয়ে যায় ভাড়ায় আনা ইঞ্জিনও।

পরে ইঞ্জিন মেরামত করতে যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। তবে কোনো সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। সেই কারণে লিজ নেয়া প্রতিষ্ঠান ও মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান উভয়কেই অর্থ দিতে হচ্ছে বিমানকে।

ওই ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসার পর গত জুনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য কামরুল আশরাফ খানের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদনে বলা হয়, উড়োজাহাজ দুটি লিজ আনার চুক্তির সমস্ত শর্তই ছিল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে, যার ফলে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বিমানের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

চুক্তি মোতাবেক ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত আরও ২৮ মাস রাখতে হবে উড়োজাহাজটি। এ জন্য শর্ত অনুযায়ী মাসে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা হিসাবে আরও ১৪০ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হবে বিমানকে।

সংসদীয় কমিটি বলছে, রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থাটি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৭৫ কোটি টাকা লাভ করলেও এই দুটি উড়োজাহাজের ক্ষতিতে ওই সাফল্য নষ্ট হচ্ছে।