বিল গেটসকে ছাড়িয়ে সর্বকালের সেরা ধনী মানসা মুসা, জানেন কে এই ব্যক্তি?

বিশ্বের শীর্ষ সম্পদশালী মানুষের কথা মনে হলেই আমাদের সামনে যে নাম গুলো চলে আসে তা হলো বিল গেটস, কার্লোস স্লিম, ওয়ারেন বাফেট, রথচাইল্ড কিংবা রকফেলার পরিবারের নাম। আর তরুণ ধনকুবের হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ।

তবে যদি বলা হয়, আরও এখন থেকে প্রায় ১৪ শতক আগে পশ্চিম আফ্রিকার এক ধনকুবের তাদের সবার চেয়ে অনেক বেশি সম্পদের মালিক ছিলেন। তাহলে কি আশ্চর্য হবেন? আপাত আশ্চর্যজনক মনে হলেও, এটাই সত্য। ১৪ শতকের সেই ধনকুবেরের কাছে বিল গেটসরাও কিছু না।

২০১২ সালে ইতিহাসের ধনী ব্যক্তিদের সম্পদের পরিমাণ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে গবেষণা সংস্থা ‘সেলিব্রেটি নেট ওয়ার্থ’। এতে ওই ধনকুবেরকে বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে ধনী মানুষের খেতাব দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষের তালিকায় শীর্ষে রেখেছে তাকে।

তবে কে এই ব্যক্তি? বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনী ওই ব্যক্তির নাম মানসা মুসা। ‘মানসা’ তার নামের অংশ নয়; উপাধী। এর অর্থ সুলতান বা সম্রাট। মুসার পুরো নাম ‘প্রথম মুসা কিতা’। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির সুলতান হওয়ার কারণে তাকে মানসা খেতাবে ভূষিত করা হয়। মানসা ছাড়াও কমপক্ষে আরো ডজনখানেক উপাধী ছিল তার। তাকে প্রথম মুসা, মালির আমির, ওয়াংগারা খনির সম্রাট, কনকান মুসা/ কানকো মুসা, মালির সিংহ, গঙ্গা মুসা ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।

মানসা মুসার জন্ম আনুমানিক ১২৮০ সালে এবং মৃত্যু ১৩৩৭ সালে। তিনি ছিলেন মালি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সান্দিয়াতা কিতার ভাগ্নে। ১৩০৭ সালে ৩২ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি প্রথম আফ্রিকান শাসক, যিনি ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন।

মুসা মালির দশম মানসা। ২০১২ সালের জরিপ মতে, ৪০ হাজার কোটি ডলারের মালিক ছিলেন মুসা। যেখানে ২০১৭ সালে ফোর্বসের হিসাব মতে, বিল গেটসের নেট সম্পদের পরিমাণ ৮ হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার।

শুধু সম্পদ নয়, বিশাল একটি সেনাবাহিনীও ছিল তার, যাকে আজকের দিনে বলা যায়, ‘সুপারপাওয়ার আর্মি’। তার সেনাবাহিনীতে সদস্য ছিল দুই লক্ষাধিক, যার মধ্যে ৪০ হাজারই ছিল তীরন্দাজ। তখনকার দিনে এত সংখ্যক সেনাবাহিনী ছিল কল্পনাতীত। ক্ষমতায় আরোহণের পর আফ্রিকার ২৪টি বড় বড় শহর জয় করেছিলেন তিনি।

মুসা ছিলেন একাধারে দক্ষ শাসনকর্তা, ধর্ম প্রচারক, শিক্ষা ও বিজ্ঞান অনুরাগী এবং অত্যন্ত দানশীল ব্যক্তিত্ব। ইউরোপকেও তিনি এতোটা প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন যে তাদের আকা আফ্রিকার মানচিত্রে মুসার ছবি ব্যবহার করা হতো।

মুসার মক্কায় হজ করতে যাওয়ার একটি ঘটনা আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে খুবই আলোচিত। মালির এই শাসক মনে করতেন, ইসলামে প্রবেশ মানে হচ্ছে একটি সভ্য সাংস্কৃতিক দুনিয়ায় পদার্পণ। নিজের সাম্রাজ্যের মধ্যে ধর্ম প্রসারের কাজেই বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতেন তিনি। ১৩২৪-২৫ সালের মধ্যে হজ করতে গিয়েছিলেন মুসা। ওই সময় তার সঙ্গে ছিল ৬০ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে ১২ হাজার ছিল সেবক।

এসব সেবকের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল একটি করে সোনার বার। এছাড়া ৮০ থেকে ১০০টি উট ছিল বহর, যেগুলো প্রত্যেকটি প্রায় ১৪০ কেজি করে স্বর্ণ বহন করছিল। যাত্রাপথে কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের সোনা বিতরণ করেন তিনি। এত বেশি স্বর্ণ বিতরণ করেছিলেন যে পরের কয়েক বছর কায়রো, মক্কা এবং মদিনায় স্বর্ণের দাম একেবারেই নেমে গিয়েছিল। এতে অবশ্য শহরগুলোর অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বেড়ে গিয়েছিল মুদ্রাস্ফীতি।

মুসার এই হজযাত্রায় সঙ্গী হন তার প্রথম স্ত্রী। এছাড়া নিযুক্ত ছিলেন আরো ৫০০ সেবিকা। কাফেলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষক, চিকিৎসক, সরকারি কর্মকর্তা ও সংগীতশিল্পীও ছিলেন। কথিত আছে, প্রতি জুমাবারে একটি করে মসজিদ নির্মাণ করতেন তিনি। মক্কায় হজ পালনের পর আরব বিশ্বের একটি বড় অংশ ঘুরে বেড়াতে থাকেন এই পশ্চিম আফ্রিকান শাসক।

তখন মক্কাবাসীর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। ফেরার সময় সেখান থেকে বহু উট বোঝাই করে চিকিৎসা, জোতির্বিদ্যা, দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, গণিত এবং আইন বিষয়ে প্রচুর বই নিয়ে আসেন। এছাড়া মক্কার সবচেয়ে মেধাবী এবং সেরা গণিতবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও স্থাপত্যবিদদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন মালিতে। ইসলামি শিক্ষাভিত্তিক অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং নিজের সাম্রাজ্য থেকে উত্তর আফ্রিকার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষার্থী প্রেরণ করেন মুসা।

বলা হয়ে থাকে, ওই হজে মুসা আজকের দিনের প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড ওজনের স্বর্ণ ব্যয় করেছিলেন। মালি সাম্রাজ্যের প্রায় ৪০০ শহরকে আধুনিক রূপ দিয়েছিলেন আলোচিত এই শাসক। তার নির্মিত উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যের মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব শাঙ্কোর, হল অডিয়েন্স, গ্র্যান্ড প্যালেস ইত্যাদি রয়েছে।

আফ্রিকার বিশাল অংশজুড়ে বিস্তৃত ছিল মুসার সাম্রাজ্য। তার সময়েই মালি সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে। ইতিহাসবিদদের মতে, তার সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল প্রায় ১২ লাখ ৯৪ হাজার ৯৯৪ বর্গকিলোমিটার। বর্তমান সময়ের মালি, আইভরি কোস্ট, মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, নাইজার, গাম্বিয়া, বুর্কিনা ফাসো, গিনি, গিনি বিসাউ, ঘানা ইত্যাদি দেশগুলোও তখন মালি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।

মক্কায় হজপালনকালেই মুসা খবর পান, তার জেনারেল সাগমান্দিয়া গাও শহর দখল করেছে। বিজয়ের পর শহরটি সফর করতে যান তিনি। সেখানে গিয়ে গাও সম্রাটের দুই পুত্রকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেন এবং মালি সাম্রাজ্যের রাজধানী নিয়ানিতে নিয়ে আসেন। তাদের দুই ভাইকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। মালির থিমবুকতু শহরকে বৃত্তিপ্রাপ্ত মুসলিমদের শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করেন এই সম্রাট।

একইসঙ্গে শহরটি হয়ে ওঠে বাণিজ্য এবং সংস্কৃতি চর্চার একটি কেন্দ্রও। ভেনিস, গ্রানাডা এবং জেনোয়ার মতো ইউরোপীয় শহরগুলোতে যখন এই বাণিজ্যকেন্দ্রটির সংবাদ পৌঁছায় তখন সেখানকার ব্যবসায়ীরা দ্রুত এটিকে তাদের বাণিজ্যিক শহরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নেন।

মুসার সময় থিমবুকতু শহরের শাঙ্কোর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার আইন বিশেষজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদদের একটি মিলনমেলা। ১৩৩০ সালে পার্শ্ববর্তী মোসি সাম্রাজ্য থিমবুকতু দখল করে নেয়। সঙ্গে সঙ্গেই সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ পুনর্দখল করতে সক্ষম হন মানসা মুসা।

ওই শহরের রাজপ্রাসাদটি ধ্বংস হয়ে গেলেও এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদগুলো। তার সময়েই লাইব্রেরি অব আলেকজান্দ্রিয়ার পর আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয় ইউনিভার্সিটি অব শাঙ্কোর। সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২৫ হাজার আবাসিক শিক্ষার্থী বিদ্যার্জন করতো এবং পাঠাগারে ছিল এক লাখেরও বেশি বই।

টানা ২৫ বছর মালি শাসন করে ১৩৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে ধনী এই ব্যক্তি। তবে মৃত্যুর সঠিক কোনো কারণ এখনও উদ্ধার করতে পারেননি ইতিহাসবিদরা। মৃত্যুর সাল নিয়েও আছে বিতর্ক। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুনের মতে, কমপক্ষে ১৩৩৭ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তিনি। ওই বছরই আলজেরিয়া বিজয়ে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন মুসা।