মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ জরুরি

প্লাবনকালে নোয়ার নৌকোয় মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর সব প্রাণীর জায়গা হয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে সকলকে নিয়ে সীমাহীন জলরাশিতে ভেসে পড়েছিল নৌকো। কিন্তু তেমন ঘটনা এখন ঘটলে নৌকোয় আর যাই হোক, স্থানাভাব হবে না। কারণ অন্যান্য বহু প্রাণীকে মানুষ মেরে শেষ করে দিয়েছে স্রেফ নিজের লাভ দেখতে গিয়ে। নিজের ঢাক পেটানো মানুষের উৎপাতেই গত ৫০০ বছরে ৮০০টি প্রজাতির প্রাণীকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে হয়েছে।

জীববৈচিত্র রক্ষা নয়, বাড়ছে জীবননিধন যজ্ঞ। গজিয়ে উঠছে বন্যপ্রাণ ব্যবসার দুনিয়াজোড়া সিন্ডিকেট। কোনও মতে চলা মফস্সলের মলিন সার্কাসে বন্যপ্রাণী নিয়ে খেলা দেখানো বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দ্বীপবাসী ধনীদের প্রাইভেট চিড়িয়াখানায় তালা ঝোলেনি। ফুটপাথে রূপ-যৌবনবর্ধক জীবজন্তুর হাড়গোড়, পশুপাখির তেল বিক্রি খানিকটা কমেছে, কিন্তু দিব্যি চলছে টাইগার বাম। এগোচ্ছি না পিছোচ্ছি, বোঝা দায়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দেশ চিনেও বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ওষুধ, মলম, বাম বানানোর জমজমাট ব্যবসা। এই ব্যবসা বাড়ছে। আমাদের ঘরের কাছেই নিয়মিত বন্যপ্রাণ উদ্ধার হচ্ছে। প্রতিটি জীববৈচিত্র দিবসেই পশুপাখির বিপন্নতা নিয়ে হইচই হয়। গেল গেল রব ওঠে। আর বছরভর জেগে থাকে পাড়ার বাজার থেকে বিদেশের বিমানবন্দরে চোরাই জীবজন্তু কিংবা তাদের দেহাবশেষ পাচার। তাতেও কারও হেলদোল নেই। অনেকের কাছে এটুকুও বাড়াবাড়ি। যেন কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গিতে তাঁরা বলেন, মানিয়ে নিতে না পারলে কোনও কোনও প্রাণীকে কালের নিয়মেই বিলুপ্ত হতে হয়। এটাই ইতিহাসের নিয়ম! কিন্তু তক্ষক, বেজি, বনরুই, ভোঁদড়, গোসাপ, মেছো বিড়ালদের আমরা যারা শুধুমাত্র ব্যবসার জন্য মেরে বা চালান করে অদৃশ্য করে দিলাম, তাদের তো কালের নিয়মে অবলুপ্ত হওয়ার কথা ছিল না! আমাদের লোভই তো তাদের বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিল!

জীববৈচিত্র সংরক্ষণ আইন, প্রচার, নিশ্চয় দরকার। কিন্তু মনে হয়, তার থেকেও বেশি জরুরি, পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব যে মানুষের টিকে থাকার প্রয়োজনেই, তা বুঝতে শেখা। সহমর্মিতার শিক্ষা কিন্তু সব ধর্মেই আছে। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন— সব ধর্মেই মানুষ ও প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখতে জীববৈচিত্র রক্ষার কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধধর্মে তো প্রকৃতি ও জীববৈচিত্রকে কোনও বাইরের ব্যাপার বলে ধরাই হয় না। বুদ্ধ বলেছেন, পৃথিবীর সব প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ও পারস্পরিক নির্ভরতার কথা। আমাদের এই ভুবনগ্রাম যত ছোট হচ্ছে, ততই কিন্তু পৃথিবীর সব প্রাণীর এই পারস্পরিক নির্ভরতা বাড়ছে। এই সত্যটা বহুকাল আগেই বুঝেছিলেন বুদ্ধ। এই নির্ভরতা বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনেই তিনি একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণকেও রক্ষা করার কথা বলেছিলেন। কারণ সেই জীবটি একটা গোটা ব্যবস্থারই অঙ্গ।

নোয়ার নৌকোয় উঠতে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়েছিল গরু, ঘোড়া, ভেড়া, বাঘ, সিংহ, জিরাফ, জেব্রা থেকে শুরু করে পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকুল। পৃথিবীর জীববৈচিত্রের সব নমুনাই তাতে তুলে নেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তা। ভবিষ্যতে তেমন কোনও বিপর্যয়ের দিনে সভ্যতার দোড়গোড়ায় হয়তো এসে দাঁড়াবে কোনও পেল্লায় লাইফ ক্যাপসুল। যাতে চড়ে কোনও গ্রহের দিকে পাড়ি দেবে মানুষ! তবে সেই যাত্রায় কোনও রং থাকবে না। কারণ, সে তো ফেলে যাচ্ছে প্রাণের বৈচিত্রের এক বিপুল ধ্বংসাবশেষ!