মিয়ানমার থেকে মুখ সরাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ

মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াংগুন থেকে একদল কর্মকর্তা গত জুনে ইউরোপের ছয়টি দেশ সফর করেন যোগাযোগ, জ্বালানি আর শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণের আশা নিয়ে। কিন্তু তার বদলে সব জায়গায় তাদের রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে খনিজসমৃদ্ধ কিন্তু জাতিগতভাবে বিভক্ত রাখাইন রাজ্যে যুগের পর যুগ নির্যাতিত হয়ে আসছে রাহিঙ্গারা।

‘যেখানে গেছি, প্রত্যেকটা দেশে তারা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে,’ বলেন হ্লাইং মো উ, যিনি ইয়াংগন নগর উন্নয়ন কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ১৬ দিনের ওই সফর শেষে দেশে ফেরার পর গত মাসে রাখাইনের পরিস্থিতির নাটকীয় অবনতি হতে শুরু করে।

সেনাবাহিনীর নতুন দমন অভিযান থেকে বাঁচতে এ পর্যন্ত চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিসংঘ একে চিহ্নিত করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে। পাঁচ দশকের বেশি সময় সামরিক শাসনের অধীনে থাকা মিয়ানমার আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে পশ্চিমা বিনিয়োগ পেয়েছে সামান্যই।

দুই বছর আগে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্যে দিয়ে সেই অবস্থা পাল্টানোর আশা করছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি।

গণতন্ত্রে ফেরার পর বেশিরভাগ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় মিয়ানমারে পশ্চিমা বিনিয়োগের জোয়ার আসবে বলে অনেকে মনে করছিলেন। এ অঞ্চলের কূটনীতিবিদরা ওই সম্ভাবনাকে দেখছিলেন মিয়ানমারের ওপর ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাবে ভারসাম্য আনার সুযোগ হিসেবে।

কিন্তু রাখাইনে সেনা অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধের পদক্ষেপ না নেওয়ায় মিয়ানমারের নেত্রী সু চি এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে রয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের যেসব কোম্পানি এতদিন মিয়ানমারে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনায় ছিল, এখন তারা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছে বলে আইনজীবী, পরামর্শক ও লবিস্টরা জানিয়েছেন।

ইয়াংগনভিত্তিক ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম ফেয়ারক্যাপ পার্টনার্সের ম্যানেজিং প্রিন্সিপাল লুইস ইউং জানান, তাদের অংশীদার প্রথম শ্রেণির একটি মার্কিন বেভারেজ কোম্পানি আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মিয়ানমারে ব্যবসা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং প্রশাসনিক সংস্কারের ধীর গতির কারণে তারা সেই পরিকল্পনা স্থগিত করেছে।

‘মোদ্দা কথা হল, বিনিয়োগের জন্য এটা সঠিক সময় বলে তারা মনে করছে না। তারা সরকারকে আরও উদ্যোগী দেখতে চায়, কিন্তু রাখাইনের পরিস্থিতি এখন অনুকূল নয়।’

কেবল সম্ভাব্য উদ্যোক্তা নয়, যারা ইতোমধ্যে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের দিক থেকেও চাপ বাড়ছে সু চি সরকারের ওপর। অধিকার সংগঠন এএফডি ইন্টারন্যাশনাল ইতোমধ্যে সব বিদেশি কোম্পানিকে মিয়ানমারে ব্যবসা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস কোম্পানি শেভরনের বিনিয়োগকারীদের একটি ছোট গ্রুপ তাদের সর্বশেষ সাধারণ সভায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানির সঙ্গে করা চুক্তি প্রত্যাহারের দাবি তুললেও তা পাস করাতে ব্যর্থ হয়। মিয়ানমারে মোবাইল ফোন সেবার ব্যবসায় থাকা নরওয়ের কোম্পানি টেলিনর সম্প্রতি রাখাইনের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে একটি বিবৃতি দেয়।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিটির চেয়ারম্যান বার্নড ল্যাঞ্জ জানান, তাদের একটি প্রতিনিধি দলের মিয়ানমার সফরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু গত সপ্তাহে তা স্থগিত হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্ভাব্য বিনিয়োগ চুক্তি নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য সেখানকার পরিস্থিতি এখন অনুকূল নয়।’

মিয়ানমারে কনফারেন্স করার পরিকল্পনা করছিল এমন অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি এখন অন্য দেশের কথা ভাবছে বলে জানিয়েছেন মিয়ানমার টুরিজম ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যান খিন অং তুন।

গ্লোবাল রিস্ক কনসাল্টেন্সি ফার্ম কন্ট্রোল রিস্কের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান ডেইন শ্যামোরো বলেন, মানুষ সবেমাত্র মিয়ানমারকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা শুরু করেছিল। আর এখন কোথাও মিয়ানমারের কথা তুললেই সবাই শরণার্থী আর টিভিতে দেখা ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর বলতে শুরু করে।

নিক্কেই এশিয়া রিভিউয়ে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারের নেত্রী সু চি স্বীকার করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা।

তবে তিনি এও বলেন, দারিদ্র্যপীড়িত রাখাইন অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিকল্প নেই। বিনিয়োগ পাওয়া গেলে সেটাই হবে পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়ক।
চীনের অক্ষ

মিয়ানমারের ৭০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর জন্য অবশ্যই বিনিয়োগের একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। তা আরও লোভনীয় হয়ে ওঠে তেল-গ্যাসের মত প্রাকৃতিক সম্পদ; রুবি ও জেডের মত রত্নের খনি আর দামি কাঠের বিপুল সম্ভারের কারণে।

মিয়ানমারের মজুরি তুলনামূলকভাবে সস্তা আর ৫ কোটি জনসংখ্যার এই দেশের একটি বড় অংশ বয়সে তরুণ, যারা কল-কারখানার কাজের জন্য মুখিয়ে আছে।

গত এপ্রিলে মিয়ানমার তাদের বহু প্রতীক্ষিত বিনিয়োগ আইন পাস করে। সেখানে প্রক্রিয়াগত জটিলতা কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও স্থানীয়দের মত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়। কেবল তাই নয়, এ বছরের শেষ দিকে আরও একটি আইন পাস হওয়ার কথা, যার মাধ্যমে স্থানীয় কোম্পানির শেয়ার কেনার সুযোগ দেওয়া হবে বিদেশিদের।

বিনিয়োগ বিষয়ে পরামর্শ সেবাদানকারী ফার্ম দেজান শিরা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের আসিয়ান বিভাগের প্রধান ডাস্টিন ডয়ের্টি বলেন, ‘সব কিছু মিলিয়ে মিয়ানমারে ব্যবসার পরিবেশ ক্রমশ ভালোর দিকেই যাচ্ছিল। অবশ্য এখন যদি পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিংবা তাদের সরকার যদি নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে, তাতে মিয়ানমার যে খুব বেশি বেকায়দায় পড়বে, তা নয়।’

চীন যখন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ধারণা নিয়ে এশিয়াজুড়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা বাড়ানোর বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, তখনই সু চি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে তৎপর হয়েছেন।

মিয়ানমারের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা চীনের। এর পরেই রয়েছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, জাপান ও ভারত। এই পাঁচ দেশের কোনোটিই এর আগে মিয়ারমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধে অংশ নেয়নি।

মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার আকার মাত্র ৪০ কোটি ডলার। মিয়ানমারে মোট বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। আর বিনিয়োগের মোটামুটি ১০ শতাংশ আসছে ইউরোপ থেকে।

অন্যদিকে চীন আর সিঙ্গাপুর থেকে মিয়ানমার তাদের মোট বিনিয়োগের এক তৃতীয়াংশের বেশি পাচ্ছে। আরও এক তৃতীয়াংশের যোগান দিচ্ছে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড।

মিয়ানমারের ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কোম্পানি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দপ্তরের উপ পরিচালক থান অং কিয়াও বলেন, রাখাইনের পরিস্থিতি না বদলালে ইউরোপের বিনিয়োগকারীরা অন্য বিকল্প ভাবলেও ভাবতে পারেন। কিন্তু এশিয়ার বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমার ছেড়ে যাবেন না বলেই তার বিশ্বাস।

চীন ইতোমধ্যে মিয়ানমারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির আলোচনা শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত যোগাযোগের পথ তৈরির বিষয়টি এগিয়ে নিচ্ছে। গত এপ্রিলে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছে, যার মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে জ্বালানি তেল পৌঁছাবে।

আর এর মধ্যে দিয়ে অং সান সু চি পুরোপুরি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মুঠোর মধ্যেই চলে যাবেন বলে স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডিফেন্স স্টাডিজের প্রধান জন বাক্সল্যান্ডের ধারণা।