‘মেয়ে, ডাকলেই তুই যাস কেন?’

চিররঞ্জন সরকার : গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে সাফাত আহমেদ নামে এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে তথাকথিত বন্ধুর সঙ্গীদের ফাঁদে পড়ে ধর্ষণের শিকার হন দুই তরুণী। অনেক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে, অনেক বাধা-বিপত্তি-হুমকি উপেক্ষা করে, অনেক সাহস সংগ্রহ করে অবশেষে ঘটনার প্রায় ৪০ দিন পর বনানী থানায় মামলা করেন তারা। মাললায় আসামি মোট ৫ জন, আসামিরা হলেন- সাদনান সাফিক, তার বন্ধু সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, সাফাতের ড্রাইভার বিল্লাল ও তার দেহরক্ষী।

এই ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ ওই তরুণী দুটির বিরুদ্ধেই ক্ষোভ ঝাড়ছেন। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের এই পুরুষের স্বার্থে, পুরুষের ‘রীতিনীতি’ দ্বারা পরিচালিত সমাজে বেশিরভাগ নারী-পুরুষই পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন। এখানে নারীকে দেখা হয় পুরুষের চেয়ে হীন, নিচু এক প্রাণী হিসেবে। যারা পুরুষের ইচ্ছে অনুযায়ী চলবে, ফিরবে, বাঁচবে। কোথাও কোনও ব্যাপারে পুরুষকে দায়ী করা চলবে না। পুরুষ যদি জোর-জবরদস্তি করে, মারে-পেটায়, এমনকি ধর্ষণও করে, তবু তা অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হয় না!

কাজেই বনানীর ওই ধর্ষণের ঘটনার সব দোষ ওই দুই তরুণীর। কেউ কেউ জোর গলায় বলছেন, বন্ধুর বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে কেন যাবি? তোরা নিজের নিরাপত্তার হিসেব করলি না কেন? বন্ধু ডাকলেই যেতে হবে কেন? তা-ও রাতের বেলা?

সব দেখে-শুনে আমাদেরও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, মেয়ে, তুই ডাকলেই যাস কেন? মেয়ে আসলেই তোদের ভাবা উচিত ছিল, সব পুরুষ মেয়েদের বন্ধু হয় না! ওদের কেউ কেউ জন্মদিনের কথা বলে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে তোকে ধর্ষণ করতে পারে। সমাজে এখন বিশ্বাস আর আস্থা বলে কিছু নেই। বন্ধু বলে কিছু নেই। যে কেউ যে কোনও সময় ধর্ষক হয়ে উঠতে পারে, কামকাতর পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে! ওরা বন্ধুত্বের ফাঁদ পাতবে, সেই ফাঁদে ফেলে তোকে খুবলে খাবে! মেয়ে, তোরা এসব বুঝিস নাই কেন?

তোরা আসলে ‘ভালো’ মেয়ে না। তোরা সমাজের রীতিনীতি জানিস না! আমাদের সমাজে ভালো মেয়ে হলো সেই মেয়ে, যার যৌনতা হবে অন্যের ইচ্ছে অনুযায়ী। পুরুষের শর্তে, পৌরুষের শর্তে। ছেলেরা তাই পাতার পর পাতা মেয়েদের শরীরের বর্ণনা দিলে দোষ হয় না, কিন্তু মেয়েরা যদি ‘সালাম আমার প্রেমিক’ লিখে বসে, দোষ হয় খুব, কারণ তাতে পুরুষতন্ত্রের মান যায়! পুরুষতন্ত্র তোদের যেভাবে চলতে বলবে, তোদের সেভাবেই চলতে ও বলতে হবে। তা না হলে সমাজের তালভঙ্গ হবে।

সমাজের ব্যাকরণ অনুযায়ী, মেয়ে জিন্স পড়েছে, অমনি সে খারাপ মেয়ে। মেয়ে একটু জোরে হেসেছে, ওমনি সে খারাপ মেয়ে। মেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরেছে, ওমনি সে খারাপ মেয়ে। মেয়ের ছেলে বন্ধু আছে, ওমনি সে খারাপ মেয়ে। মেয়েটা স্লিভলেস জামা-ব্লাউজ পড়ে, অমনি সে খারাপ মেয়ে। মেয়ের লিপস্টিকের রঙটা কড়া, অমনি সে খারাপ মেয়ে। মেয়েটা একটা ছেলেকে ভালোবাসে ওমনি সে খারাপ মেয়ে। মেয়েটা নারী অধিকারের কথা বলে, ওমনি সে খারাপ মেয়ে। সহনশীল, শান্তশিষ্ট, চুপচাপ, ‘শালীনতা’ বজায় রেখে পুরুষের অধীনস্থ থেকে জীবন ধারণ করা মেয়েরাই ভালো। ভালো মেয়েরা নিজেকে সব সময় ঢেকেঢুকে রাখবে, সারাদিন ঘামটি মেরে ঘরে থাকবে, বাবা-মার ইচ্ছে অনুযায়ী চলবে। বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে ‘সুখী’ হবে। ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ এটা জীবন দিয়ে হলেও প্রমাণ করবে। তারা পরিবারের সবার দিকে খেয়াল রাখবে, শ্বশুর-শাশুড়ির কথা মতো চলবে, স্বামীর অবাধ্য হবে না এবং ঘরের বাইরে যাবে না। যেকোনও পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নেবে, যুক্তি-তর্ক বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না।

কিন্তু তোরা তা করিসনি। তোরা ক্ষমতাবান পিতার ‘পুরুষসিংহ’ লোলুপ সন্তানদের ভোগের সামগ্রী হয়েছিস, বেশ হয়েছে! কিন্তু মামলা করতে গেলি কেন? তোরা জানিস না, এদেশে বড়লোক ও ক্ষমতাবানরা কাউকে খুন করলে, ধর্ষণ করলে কিছু হয় না। সাগর-রুনিকে যারা মেরেছে তাদের কিছু হয়েছে? ত্বকি, তনুকে যারা হত্যা করেছে, তাদের কিছু হয়েছে? রাঙামাটিতে রোমেল চাকমাকে যারা হত্যা করেছে, তাদের কিছু হয়েছে?

বড়লোক আর ক্ষমতাবান বাপ থাকলে ধর্ষণ করা যায়! খুন করা যায়। যা খুশি তাই করা যায়। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে-শুনে তোরা কিছুই বুঝিস না?

তোরা তো জানিস, ধর্ষণ কতো নির্মম কতো নিষ্ঠুর একটা জিনিস। ধর্ষণ কথাটার মধ্যে কতখানি অনিচ্ছা, জোর, কষ্ট, ব্যথা, ঔদ্ধত্য, নিষ্ঠুরতা রয়েছে! কিন্তু তারপরও এগুলো চেপে রাখতে হয়। অথবা ‘উপভোগ’ করতে শিখতে হয়! ধর্ষণ তো হয়েই গেছে, এখন এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করে কে সবচেয়ে অপমানিত হলো? তোরা নিজেরা! সমাজে ছেলেদের কোনও কলঙ্ক-অপমান হয় না। বড়লোকদের তো আরও না! নিজের সম্মানকে জলাঞ্জলি দিয়ে তোরা কিভাবে বলতে পারলি, ‘ওরা আমাদের ধর্ষণ করেছে?’ ওরা যে কতখানি আনন্দ পেল, ধর্ষণের চিত্র ভিডিও করে কী অসীম বীরত্ব দেখাল, তা কিছুই না?

ওরে মূর্খ মেয়ে, এ রকম হতেই পারে! তুই যতই অপাপবিদ্ধ হোস না কেন, দুর্ভাগ্য নেমে আসতেই পারে যখন-তখন। অতএব সাবধান। নিজেকে ঢেকেঢুকে লুকিয়ে রাখ। যে ট্র্যাডিশন চলছে, তাই চলবে। এই সংস্কৃতি থেকে সরে আসার বদলে আমরা এই সংস্কৃতিকে চুনকাম করে গিয়েছি। চুনকাম আর চাপাচুপির ফলে যেটা এত দিন ঘটেছিল আমরা ধর্ষণকে ঠিক ওই নামে ডাকতাম না। শ্লীলতাহানি, ইজ্জত লোটা থেকে শুরু করে নানা ঢাকা-চাপা নাম ছিল জিনিসটার। কিছু বেহায়া মানুষের কারণে ধর্ষণ শব্দটা কেন জানি প্রচলিত হয়ে উঠেছে। আর এখন ধর্ষণ শব্দটা বার বার শুনতে শুনতে আমাদের মন এমন অসাড় অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে যে এখন একটি মেয়ে কোনও পুরুষের অবাঞ্ছিত স্পর্শ নিয়ে আপত্তি জানালে কেউ কেউ এমনটাও বলছেন: তাতে কী হয়েছে, ধর্ষণ করে মেরে তো আর ফেলেনি?

পুনশ্চ: যে সব গণমাধ্যমকর্মী অভিযোগকারী মেয়েদুটির বাড়ির সামনে আস্তানা গেড়েছেন, মেয়েদুটিকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছেন, তাদের উদ্দেশে নিবেদন: আপনারা ধর্ষকদের খুঁজুন। তাদের নিয়ে প্রতিদিন একটি করে প্রতিবেদন ছাপুন। তারা কোথায় পালালো, কিভাবে পালালো, আর কতো অপকর্ম করেছে, সেই ফিরিস্তি বের করুন। যে মেয়েদুটি পুরো স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন, তাদের পরিচয় জানার দরকার নেই। নতুন করে তাদের কথা শোনারও দরকার নেই। তারা তো মামলার এজাহারেই সব কিছু বলেছেন। এখন দরকার সেই ধর্ষকদের চরিত্র উন্মোচন করা, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো।

মনে রাখা দরকার যে, ধর্ষণ শুধু পুরুষের যৌনতার প্রকাশ নয়, ক্ষমতারও প্রকাশ। কিন্তু সেখানেই তো থেমে যাওয়া চলে না। সব মানুষের মধ্যেই কঙ্কাল থাকে, তা বলে কঙ্কালটাই মানুষ নয়। প্রায় যে কোনও নির্যাতনই ক্ষমতার অসাম্যের ফল। সেটা গোড়ার কথা। শেষ কথা নয়, কথার সবটাও নয়। ধর্ষণের খবর লিখতে হলে পুরুষতন্ত্র ও ক্ষমতাতন্ত্র নিয়ে লেখার ইচ্ছে এবং ক্ষমতা, দুটোই থাকতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট