যার এক নির্দেশেই থেমে যেতে পারে রোহিঙ্গা হত্যা

সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম। গত দুই সপ্তাহে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ৩ হাজারেরও বেশি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ২ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

অথচ এসব হত্যা আর নৈরাজ্য থেমে যেতে পারে শুধু একজনের নির্দেশেই। যার সরাসরি নির্দেশে চলছে এই গণহত্যা তিনি হলেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেদেশের নোবেল জয়ী অং সান সু চির দিকে তাকিয়ে থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা আসলে এই সেনাপ্রধানের হাতে।

গত সোমবার মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসের প্যারেডে সেনাপ্রধান মিন অং বলেন, আমরা এরই মধ্যে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছি আমাদের দেশে রোহিঙ্গা নেই। রাখাইন রাজ্যে থাকা বাঙালিরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা কেবল আমাদের দেশে থাকতে এসেছে। তাদেরকে কোনোভাবেই মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কী করা উচিত সে ব্যাপারে আইন অনুযায়ী আমাদের দায়িত্ব আছে। সার্বভৌমত্বকে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বর্ণবৈষম্যজনিত সঙ্কট থেকে সুরক্ষিত রাখারও দায়িত্ব আছে আমাদের।

দেশটির বর্তমান বিধি অনুসারে ৬০ বছরে সেনাপ্রধানের অবসরে যাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি সেনাসূত্রকে উদ্ধৃত করে স্থানীয় গণমাধ্যম ভয়েস গত বছর এক খবরে বলেছিল, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইয়াং অতিসত্বর ৬০ বছরে পা রাখবেন। তিনি কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে আরও পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করবেন। ওই খবরে আরও বলা হয়, মিন অং হ্লাইয়াংয়ের ডেপুটি সো উইনের মেয়াদও পাঁচ বছর বাড়বে।

সম্প্রতি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের প্যারেডে সেনাপ্রধান মিন অং হাইং রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী ১০ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গাকে বাঙালী অনুপ্রবেশকারী বলে দাবী করেছেন।

তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর যে প্রস্তাব সম্প্রতি জাতিসংঘে পাস হয়েছে,তা সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তিনি আরো বলেন,’আমরা এরই মধ্যে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছি যে আমাদের দেশে কোনো রোহিঙ্গা নেই। রাখাইন রাজ্যে যে সব বাঙালী আছে, তারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। আমাদের কি করা উচিত সে ব্যাপারে আইন অনুযায়ী আমাদের দায়িত্ব আছে। আমাদের সার্বভৌমত্বকে রাজনৈতিক,ধর্মীয় ও বর্ণবৈষম্যজনিত সংকট থেকে সুরক্ষিত রাখারও দায়িত্ব আছে আমাদের।’

গত বছর ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের একটি এলাকায় সীমান্ত পোস্টে সন্ত্রাসীদের হামলায় ৯ পুলিশ নিহত হন। এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দমন-পীড়নের অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। এতে নারী শিশুসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়, নির্যাতিত হয় হাজার হাজার নারী। গ্রামের পর গ্রাম রোহিঙ্গাদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে বাড়ীঘর ছেড়ে শরণার্থী হয়।

জাতিসংঘের হিসাবে অনুযায়ী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে টিকতে না পেরে তিন মাসে অন্তত ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা ঘরবাড়ী ছেড়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যমতে গত কয়েক বছরে সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী হিসেবে দুই লাখ ৩১ হাজার ৯৪৮ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার অভিযোগ তুলে জাতিসংঘ বলেছে, রাষ্ট্রীয় মদদে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়েছে। গত ২৪ মার্চ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে অনুমোদিত হয়।

সিদ্ধান্ত হয় যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের জন্য দেশটিতে সত্য অনুসন্ধানকারী দল পাঠাবে জাতিসংঘ। ওই প্রস্তাবে বলা হয় দোষীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওই তদন্ত শুরু হবে। জাতিসংঘের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বক্তব্য আসার আগে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন পররাষ্ট্র দপ্তর তদন্ত প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। এক বিবৃতিতে তারা বলেছিল, আর্ন্তজাতিক তদন্ত কমিশন গঠন বিষয়টির সমাধানের পরিবর্তে এটিকে আরো উসকে দেবে।

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা মুসলিমদের ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সব রকমের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করারও সুপারিশ করা হয়েছে।(সুত্র: দ্য সিডনি মনিং হ্যারাল্ড,প্রেস টিভি,আলজাজিরা ও চ্যানেল নিউজ এশিয়া)