যে কোনো মৃতদেহ পাওয়া গেলে ফারুক দৌড়ে চলে আসে

কাজী ওয়াজেদ : মানুষ তার নিজ কর্ম নিয়ে যতটা না ভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা এবং চিন্তা করে অন্যের কাজ নিয়ে। অনেকেই ভাবে, আমি বর্তমান কাজ বা চাকরিটা না করে যদি অন্যকিছু করতাম তবে সফল হতাম এর চেয়ে বেশি। আবার অনেকে ভাবে, আমি অন্যজনের চাকরি বা কাজটা করলে তার চেয়ে আরো ভালভাবে করতে পারতাম, আরো দ্রুত সেবা দিতে পারতাম।

ব্যাংকে রাখা নিজের গচ্ছিত টাকা উঠানোর জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ ভাবে, ক্যাশিয়ার সাহেব খুবই স্লো। আমি ক্যাশে বসলে মানুষের লাইনটা এত বড় হতো না বরং ঝটপট কাজ শেষ হতো। কিন্তু আমার বিশ্বাস দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া ক্যাশিয়ার সাহেবরা সবসময় তাদের সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করেন যাতে সবাইকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিয়ে দ্রুতই বিদায় করা যায়।

যে খেলোয়াড়রা মাঠে খেলে তারা সবসময় সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে ভাল খেলার জন্য। আর আমরা বাইরে বসে ভাবি এর চেয়ে অনেক ভাল খেলতাম আমি। আসলেই কি তাই? অবশ্য আমি নিজে অন্য কোন পেশায় সাকসেস হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দিহান।

আমি মনে করি, সবাই তার নিজ নিজ যোগ্যতাবলেই কাজ পায় এবং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই নিজ দায়িত্ব পালন করে। অর্থাৎ যিনি যে কাজের জন্য ফিট তিনি সে কাজই করেন বা পেয়েছেন। মাঝে মাঝে নিজের কাছে মনে হয় আমি এই বর্তমান কাজটা না পেলে কিছুই করতে পারতাম না। অন্য যেকোন কাজের জন্যই আমি চরমভাবে অযোগ্য। তাই সৃষ্টিকর্তা বুঝেশুনেই আমাকে এটার জন্য নির্বাচিত করেছেন। অন্তত একজনকে দেখে সেরকম মনে হতে পারে অনেকেরই।

ছবিতে আমার পাশে থাকা ফারুক ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করে নিরলসভাবে পুলিশকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা পালন করা বিপদের বন্ধু ফারুককে তাই আদর করে “আমাদের ফারুক” বলেই ডাকি। রাতদিন যেকোন সময় “আমাদের ফারুককে” ডাক দিলে পাওয়া যাবে। পচাগলা অজ্ঞাতনামা মৃতদেহ, সড়ক দুর্ঘটনায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন দাবিদারবিহীন মৃতদেহসহ যেকোনো ধরনের মৃতদেহ পাওয়া গেলে ফারুক দৌড়ে চলে আসে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য।

গভীর রাতে বা দিনে, বৃষ্টি, পানি, কাদা বা শীতে যেকোনো সময় এলাকায় মৃতদেহ পাওয়া গেলে তার জন্য আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয় পুলিশকেই। সেসময় কেউই এগিয়ে যায় না মৃতদেহ উত্তোলনসহ পচাগলা মৃতদেহ মর্গে পর্যন্ত পৌঁছানোতে সাহায্য করতে। তখন “আমাদের ফারুকই” মৃতদেহের পোকা সরিয়ে পুলিশের সাথে ধরাধরি করে প্যাকিং করে মৃতদেহ। কখনো সড়ক দুর্ঘটনায় পিষে যাওয়া মৃতদেহের খণ্ডিত অংশ জোড়া লাগাতে, আবার কখনো টুকিয়ে টুকিয়ে মগজের অংশ পুলিশের সাথে খুঁজে বের করে। কখনো বা কবর থেকে মৃতদেহ উঠানোতে, আবার কখনো খণ্ডিত মৃতদেহ জোড়া লাগিয়ে তা সনাক্তকরনের জন্য সহায়তা করে পুলিশকে।

মৃতদেহের আত্বীয়-স্বজন থাকলেও তাদের কখনো দেখিনি একটু ধরতে। অথচ অনাত্মীয় হয়েও “আমাদের ফারুক” নিজ পরম আত্মীয় ভেবে যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণে পুলিশকে সহায়তা করে যাচ্ছে। একবার কি ভাবা যায়, প্রচণ্ড গন্ধযুক্ত মৃতদেহকে সযত্নে প্যাকিং করে আর আইনগত যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণে পুলিশের পাশে থেকে সহযোগিতা করে এভাবেই “আমাদের ফারুকরা” আমাদের কত সেবা করে যাচ্ছে??? এখানেও কি আমরা জোর গলায় বলতে পারবো একাজটা ওর চেয়ে আমি ভাল পারতাম?? অন্তত আমি না। মন থেকে স্যালুট করি মহাপ্রাণ এই “আমাদের ফারুককে”। ধন্য আমরা আজ এইসব “আমাদের ফারুকদের” জন্যে।

লেখক: ইন্সপেক্টর, বাংলাদেশ পুলিশ।

(লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)