যে পাঁচ নারীর সাহসী লড়াইয়ে ভারতে বাতিল হলো তিন তালাক!

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়েছে যে তিন তালাক প্রথা অসাংবিধানিক এবং তা ইসলাম ধর্মপালনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত নয়। এই রায়ের পরে সেদেশে তিন তালাক প্রথা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। খবর বিবিসির।

যদিও সাংবিধানিক বেঞ্চের ৫ সদস্যের বিচারপতির মধ্যে দুজন এই মত পোষণ করেছিলেন যে আগামী ৬ মাসের জন্য তালাক প্রথা বন্ধ করে রাখা হোক এবং ওই সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে আইন পাশ করুক।

তবে বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক তিনজন তাদের রায়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তিন তালাক প্রথা অসাংবিধানিক এবং ইসলাম ধর্ম পালনের সঙ্গে এই প্রথার কোনো যোগ নেই। তাদের রায়ই আদালতের চূড়ান্ত রায় বলে গণ্য করা হবে।

এই মামলাটিতে ‘৫’ সংখ্যাটির একটি আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। একদিকে যেমন সাংবিধানিক বেঞ্চে যে ৫ জন বিচারপতি ছিলেন, কিছুটা নজিরবিহীনভাবে সেখানে ৫টি ভিন্ন ধর্মের বিচারককে রাখা হয়েছিল।

আবার এই তালক প্রথার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যতজন তালাকপ্রাপ্ত নারী আবেদন করেছিলেন, তাদের সংখ্যাটাও ৫। আফরিন রহমান, আতিয়া সাবরি, শায়েরা বানো, ইশরাত জাহান ও গুলশান পারভিন – এই ৫ জনের করা আবেদনগুলোই একত্রিত করে মামলার নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত।

আফরিন রহমান, জয়পুর, রাজস্থান : ২০১৪ সালে আফরিন রহমানের বিয়ে হয়েছিল খুব ধুমধাম করে একটি পাঁচ তারা হোটেলে। এমবিএ পাশ করা আফরিন সে সময় একটা চাকরী করতেন। কিন্তু আইনজীবী স্বামীর সঙ্গে সংসার করার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।

আফরিন বলছিলেন, “যেরকমটা ভেবেছিলাম, যে স্বপ্ন ছিল, বিয়ের পরে সংসার করতে গিয়ে সেটা ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যেতে লাগল। সমানে পণের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। আমি রুখে দাঁড়ালে গায়েও হাত তোলা হচ্ছিল। আমি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি।”

বিয়ের এক বছরের মাথায় আফরিনের স্বামী তাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কয়েক মাস পরে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় আফরিনের মায়ের মৃত্যু হয়, আফরিনও গুরুতর আহত হন। তার বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন।

ভীষণ একা হয়ে পড়েন আফরিন। চোট থেকে যখন ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন আফরিন, সেই সময়েই তার স্বামী একটা চিঠি পাঠান তাকে এবং আরও কয়েকজন আত্মীয়কে। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, ‘তালাক, তালাক, তালাক’।

আফরিন বলেন, “আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এমনিতেই সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল, তারপরে ওই চিঠি। আমি বুঝেই উঠতে পারছিলাম না যে কী করব।”

মামাতো বোন তাকে সাহস যোগান সেই সময়ে। বুকে বল নিয়ে তালাক প্রথাকেই ভুল প্রমাণিত করতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন আফরিন। অন্যদিকে স্বামীর বিরুদ্ধে পণের দাবীতে অত্যাচার আর মারধরের অভিযোগে আলাদা মামলা দায়ের করেন।

স্বামী আর শাশুড়ী গ্রেপ্তার হলেও পরে তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে যান। তার কথায়, “যেসব নারীরা নিজেদের স্বামীর ওপরে নির্ভরশীল,
তাঁদের যাতে এই অন্যায় সহ্য না করতে হয়, তার জন্যই এই মামলা করেছিলাম।”

আতিয়া সাবরি, সাহারানপুর, উত্তরপ্রদেশ : আতিয়ার ভাইয়ের অফিসে একদিন একটা হলফনামা এসে পৌঁছালো। সেটা থেকেই তিনি জানতে পারেন যে তালাক হয়ে গেছে তার। দশ টাকার একটা স্ট্যাম্প পেপারের একেবারে নীচে লেখা ছিল, ‘তালাক, তালাক, তালাক’।

আতিয়ার প্রশ্ন, “শরিয়তে লেখা আছে যে নিকাহ তখনই পরিপূর্ণতা পাবে, যখন দুজনের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সহমত তৈরি হবে। কিন্তু একজন মানুষ কী করে নিজে নিজেই তালাক দিয়ে ছাড় পেয়ে যেতে পারে?”

তিনি এই তালাক মানেননি, কারণ তার স্বামী কোনো কথা বলেননি। ফোন করেননি – হঠাৎই তালাক লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আতিয়া সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যে এই প্রথা অসাংবিধানিক।

তিনি এরকম কোনও আইন তৈরি করারও আবেদন করেছিলেন, যার ফলে তালাক সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্তে মুসলমান নারীদেরও সমান অধিকার থাকবে। যখন আতিয়াকে তার স্বামী তালাক দেন, তখন তাদের বিয়ের মাত্র আড়াই বছর পার হয়েছিল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি একটা ছিলই।

আতিয়ার অভিযোগ, “দুটো মেয়ে জন্ম দেওয়ার দোষে অত্যাচার করা হতো আমার ওপরে। বিষ খাওয়ানোরও চেষ্টা করেছিল শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা।” শেষমেশ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল আতিয়াকে। সেখানে থাকার সময়েই পৌঁছায় ওই স্ট্যাম্প পেপার, যেখানে তিনবার তালাক লেখা ছিল।

স্বামীর বিরুদ্ধে আলাদা করে পারিবারিক হিংসার মামলা করেছিলেন আতিয়া। স্বামীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। সেই মামলা এখনও চলছে। আতিয়া বলেন, “আমার মন বলছিল আমি যদি হেরে যাই বা ভয় পেয়ে যাই তাহলে আমার ছোট মেয়েদুটোর কী হবে! ওদের জন্যই আমাকে লড়াই করতে হবে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

শায়েরা বানো, কাশীপুর, উত্তরাখন্ড : শায়েরা বানোর বিয়ে হয়েছিল ২০০০ সালে। প্রায় ১৫ বছরের বিবাহিত জীবন এক ঝটকায় শেষ হয়ে গিয়েছিল ২০১৫ সালে – তার স্বামীর একটা চিঠিতে।

স্বামী মারধর করতেন, বাড়ি থেকে বেরও করে দিতেন। কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুটোর কথা ভেবে মুখ বুজে সব সহ্য করে নিতেন তিনি। অসুস্থ শায়েরা তখন চিকিৎসার জন্য বাবার বাড়িতে ছিলেন। স্বামী স্পীড পোস্টে একটা চিঠি পাঠান, সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি তোমাকে তালাক দিলাম।’ তিনবার লেখা হয়েছিল বাক্যটা।

এক ছেলে আর এক মেয়ে তখন শায়েরার স্বামীর কাছেই ছিল। তখন থেকে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে দেখাও করতে পারেননি তিনি। শায়রা বানো বলেন, “আমি নিজেতো এই তালাক প্রথার শিকার হয়েছি। তাই চাই না যে আগামী প্রজন্মও এর ফল ভোগ করুক। সুপ্রিম কোর্টে আমি সেজন্যই এই প্রথাটাকেই অসাংবিধানিক আখ্যা দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি।”

ওদিকে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে নিয়েছেন। শায়েরা বানোর প্রশ্ন, “আমার সঙ্গে সে যেটা করেছে, একই ঘটনা যে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গেও করবে না তার কোনও গ্যারান্টি আছে?”

ইশরাত জাহান, পশ্চিমবঙ্গ : ইশরাতের স্বামী থাকতেন দুবাইতে। বিয়ের বছর ১৫ পরে একদিন হঠাৎই স্বামীর ফোন আসে। তিনবার তালাক উচ্চারণ করেই শেষ করে দেওয়া হয় তার বিবাহিত জীবন।

সম্পর্কটা টিঁকে ছিল অনেক বছর, কিন্তু কোনও সময়েই সংসারে শান্তি ছিল না। ইশরাত বলেন, “একের পর এক তিনটে মেয়ে হয়েছিল। তার জন্য আমাকে যথেচ্ছ অপমান তো করা হতই এমনকি জোর করে আমার দেবরের সঙ্গে শারীরিক সম্বন্ধ তৈরি করতেও বাধ্য করা হয়েছিল।”

শেষমেশ ২০১৪ সালে তিনি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। ইশরাত বলেন, “কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। স্বামী ঠিক করে ফেলেছিলেন যে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করবেন। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে আমাকে ফোন করে তিনবার তালাক উচ্চারণ করে বিয়েটা ভেঙ্গে দেন তিনি।”

ইশরাত লেখাপড়া জানেন না। কিন্তু এটুকু তিনি বোঝেন যে কোরানের কোথাও লেখা নেই যে পরপর তিনবার তালাক উচ্চারণ করলেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। ইশরাত বলেন, “কোরানেতো এটা লেখা আছে যে পুরুষমানুষ যদি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চান তাহলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে।”

স্বামীর বিরুদ্ধে পারিবারিক হিংসা আর দেবরের বিরুদ্ধে শারিরীক নির্যাতনের মামলা দায়ের করেছিলেন ইশরাত। কিন্তু তিনি ফিরে যেতে চান স্বামীর সংসারেই। ইশরাত জাহানের মতে, যদি কোনো ফয়সালা করতেই হয়, তাহলে আলোচনা করে ঠিক করুক। আর সন্তানদের ওপরে যেন সেই সিদ্ধান্তের কোনও প্রভাব না পড়ে এমনটা চান তিনি।

গুলশান পারভিন, রামপুর, উত্তর প্রদেশ : ইংলিশে মাস্টার্স পাশ করে গুলশান পারভিন একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তার বিয়ের জন্য শিক্ষিত ছেলে খুঁজতে তার পরিবারকে রীতিমতো কষ্ট করতে হয়েছে।

কারণ উত্তর প্রদেশে সবচেয়ে শিক্ষিত নারীদের মধ্যে একজন ছিলেন মিস পারভিন। শেষ পর্যন্ত ‘ভালো’ পরিবারের এক ছেলেকে গুলশান পারভিনের পরিবার পছ্ন্দ করলেও সে কম শিক্ষিতও ছিল বলা যায়।

কিন্তু বিয়ে টিকেনি বেশিদিন। অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। পারভিনের ভাই রাইসের অভিযোগ “তারা আমার বোনকে বাড়িতে পাঠাতো না। যখন যে গর্ভবতী হলো তখন একবার পাঠালো। বাচ্চা হবার আট মাস পর আবার এসেছিল। কিন্তু বোনের গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। ওর স্বামী ওকে ঠিকমতো খেতে, পরতে দিতো না। অনেক মারতো”।

তারপরও তিনি তার স্বামীর বাড়ি যেতেন শুধুমাত্র সন্তানের কথা ভেবে। কিন্তু যেদিনে পারভিনের স্বামী তাঁকে রড দিয়ে মারলেন তিনি সেদিনই পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালেন। এরপর পারভিনের স্বামী পুলিশের কাছে একটি চিরকুট পাঠায় যেখানে ‘তিন তালাক’ লেখা ছিল।

এরপর তিনি সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানান যেন তিন তালাক প্রথা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়।