রওনক নূরের দু’টি অনুগল্প

শেষ বিকেলের অভিমান


আজকাল বেলকনিটা ইকবাল সাহেবের প্রিয় বন্ধু। সারাদিন এই বেলকনিতে বসে রাস্তার মানুষ দেখা এখন তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন পনেরো বছর আগে। এখন অপেক্ষা কোন এক নতুন জীবনের। সারাদিন দোতলার বেলকনি থেকে রাস্তার মানুষ দেখা তার একমাত্র কাজ। তবে তার এই অবসর জীবনে মেয়ের খুলে দেওয়া ফেসবুক আইডি বেশ আনন্দে রাখে তাকে। বেশ মজার জায়গা এই ফেসবুক। প্রতিদিন কত নতুন নতুন বন্ধু। বেশ কিছু লেখালেখি জগতের ফেসবুক ফ্রেন্ড থাকায় সময়টা ভালোই যায় ইকবাল সাহেবের। তাদের লেখায় কমেন্ট করে মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হন তিনি। ফেসবুক বড় আজব জায়গা। সত্তর পার করা বৃদ্ধ লোকটিকে অনেক কমবয়সী মেয়েরাও প্রপোজ করে, এসব দেখে ইকবাল সাহেব একা একাই হাসতে থাকেন।

বিবাহিত জীবনের প্রায় চল্লিশ বছর চলছে। শাহতাজ আজ পূর্ণ যুবতী থেকে বৃদ্ধা হয়েছে। তার এই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ইকবাল সাহেবের চোখের সামনে ঘটেছে। এতটা বছরে কখনও সে স্বামীকে ছেড়ে একটি দিনের জন্যও কোথাও থাকেনি। যদিও স্বামী তাকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। হয়ত সব বাঙালি মেয়েরা এমনই হয়। তবুও ইকবাল সাহেবের খুব অবাক লাগে। এ যুগের মেয়ে হলে হয়তো তার এগুলো থাকতো না।

এক ছাদের নিচে থাকতে থাকতে দু’জনই জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন। তবুও জীবনের এই শেষ বেলাতেও কেউ স্বামীর দিকে পছন্দের চোখে তাকালে বেশ হিংসা হয় শাহতাজের। মনে হয়- স্বামী যদি তার হারিয়ে যায়। কিছুদিন আগে হঠাৎ এক পুরানো বান্ধবীর সাথে নতুন করে কথা হল ইকবাল সাহেবের ফেসবুকের কল্যাণে। পুরনো মানুষের সাথে কথা হওয়ায় শাহতাজ প্রথমে খুশি হলেও পরে খুব ক্ষেপে গিয়েছিলো। হায়রে স্ত্রী, শেষ বেলাতেও স্বামীকে হারানোর ভয়, মনে মনে হাসেন ইকবাল সাহেব।

শাহতাজ মাঝে মাঝে বেলকনিতে স্বামীর সাথে বসে ফেসবুকের গল্প শোনে। তিন কন্যার বিয়ের পর এ ঘর আর ঘরের আসবাবগুলো শাহতাজের বন্ধু হয়েছে। স্বামীর মত একটি ফেসবুক আইডি থাকলে অবশ্য মন্দ হতো না, কিন্তু শাহতাজ এগুলো কম বোঝে। মেয়েরা সবাই তাদের পরিবারের সাথে দেশের বাহিরে থাকে। মাঝে মাঝে দেশে আসে তাদেরকে দেখতে, তবে ফোনে প্রতিদিন কথা হয়। শাহাতাজ স্বামীর ফেসবুকে মেয়েদের আর নাতিনদের ছবি দেখে। তবে ইকবাল সাহেব স্ত্রীকে ফেসবুকের বিভিন্ন বন্ধুর গল্প শোনান।

এ বয়সে কেন তার স্বামীকে মেয়েরা পছন্দ করবে- এটা নিয়ে অনেক বেশি অভিমান শাহতাজের। এরা কি যুবক ছেলেদের দেখে না, ভাবে শাহাতাজ। দিন দিন স্বামীর ফেসবুক আর বন্ধুদের সাথে কথা বলা খুব বিরক্তিকর হয়ে যায় তার কাছে। ইকবাল সাহেবও বউয়ের শেষ বেলার অভিমানগুলো উপভোগ করে।

বয়সের ভারে ইদানিং শরীরটা বেশ খারাপ থাকে ইকবাল সাহেবের। কেমন করে মধুর সময় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। সেই ক্যাম্পাস মাতানো তাগড়া জোয়ান, প্রাণচঞ্চল ছেলেটি আজ বৃদ্ধ। সময়টা এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যায়, ভাবতে থাকে ইকবাল সাহেব। মনে হয়- আজ শুধু শরীরটা অবসর নেওয়ার অপেক্ষাতে আছে। আর তার সেই টুকটুকে লাজুক বউটি আজ কারো মা, কারো শাশুড়ি আর কারো নানি-বুবু হয়ে গেছে। অদ্ভুত এ পৃথিবী! কেমন করে সব পরিবর্তন হয়ে যায়।

ছোট মেয়েটার বাচ্চা হওয়ার সময় এগিয়ে আসায় শাহতাজকে কিছুদিনের জন্য আমেরিকা যেতে হবে। যদিও বাসায় স্বামীকে একা রেখে যেতে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। চল্লিশটা বছর একসাথে তারা, কখনও স্বামীকে ছেড়ে থাকেনি শাহতাজ। কিন্তু এবার মেয়েটার জন্য যেতেই হবে। যদিও ইকবাল সাহেবের কোন আপত্তি নেই। কিছুদিন ফেসবুক বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।

প্রিয় বেলকনিতে বসে আছেন ইকবাল সাহেব। রাস্তার মানুষ দেখছেন তিনি। শাহতাজ মেয়ের কাছে পৌঁছে গেছে। বেলকনি আছে, ফেসবুক আছে, কত বন্ধু আছে। কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না ইকবাল সাহেবের। প্রতিদিন শাহতাজের কত অভিমান, কত অভিযোগ। গত চল্লিশটা বছর শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে তার। কিন্তু এই অভ্যাসই যে তার ভালোবাসা ছিলো তা বুঝতে পারেনি ইকবাল সাহেব।

বেলকনি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ইকবাল সাহেব। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুটা বৃষ্টির পানি আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। শাহতাজের জন্য মনটা আজ বড় বেশি কাঁদছে। গান চলছে কম্পিউটারে, ‘লালন তোমার আরশি নগর আর কতদূর, আর কতদূর…’

****


সেক্রিফাইস

বর্ষার চোখে আনন্দ অশ্রু। কারণ আজ ঋতুর বিয়ে। ঋতু আর বর্ষার সম্পর্ক শুধু দু’বোন বললে ভুল হবে, তার থেকে অনেক বেশি কিছু। ওরা দু’জন দু’জনার। তাই বর্ষার বারবারই মনে পড়ছে ঋতুর সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিনের কথা। যখন বর্ষার বাবা ঋতুর মাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলো, তখন তাদের সাথেই এসেছিলো ঋতু। প্রথম প্রথম ঋতুকে দেখে বেশ হিংসা লাগতো বর্ষার। কিন্তু সেই ঋতুই সবচেয়ে বেশি আপন হলো বর্ষার। তাদের বাবা-মা যখন ব্যস্ত হয়ে গেলো নিজেদের জীবনে; তখন তারা দু’জনই ছিলো একে অপরের সাথী।

ঋতু আট বছর বয়স পর্যন্ত তার মায়ের সাথে একটি বাসার ছোট্ট একটি রুম সাবলেট নিয়ে থাকতো। বাসাটি ছোট হলেও তাদের সুখ কম ছিলো না। বিপত্তি ঘটলো মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর। চলে আসতে হলো মায়ের নতুন বাড়ি। মা তখন তার নতুন সংসারে অনেক ব্যস্ত। তবে নতুন বাবার একটি মেয়ে, নাম বর্ষা। প্রথম দিন থেকেই সবকিছুর ভাগ দিয়েছে ঋতুকে। নিজের ঘরে ঘুমোতে দিয়েছে, নিজের খেলনার ভাগ দিয়েছে। হয়েছে বন্ধু, সবচেয়ে আপনজন। তাদের বাবা-মায়ের নতুন সংসারে সন্তান আসায় ঋতু আর বর্ষারও যে ভালোবাসার প্রয়োজন তা তারা ভুলে গিয়েছিলো। তাই সুখে-দুঃখে তাদের দু’জনের পাশে শুধু তারা দু’জনই ছিলো।

উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর তাদের একাকী জীবনে বন্ধুু হয়ে আসে শোয়েব। অসহায় দু’টি মেয়ে নিজেদের কঠিন জীবনের সাক্ষী হতে খুব ভালো বন্ধু হিসেবে পায় তাদের। যাদের জীবনে কেউ নেই; তাদের জন্য এটি অনেক বড় পাওয়া। যদিও ছোটবেলা থেকেই মেয়ে দু’টি খুব চাপা স্বভাবের, কিছু প্রকাশ করতে নারাজ। তাই কেউই তাদের বিষয়ে তেমন কিছু জানতো না। ওদের দু’জনার একটি প্রিয় জায়গা ছিলো, যেখানে কষ্ট পেলেই ওরা দুজন চুপ করে বসে থাকতো। শোয়েব জীবনে আসার পর ওকে নিয়েও প্রিয় জায়গায় গিয়েছে মেয়ে দু’টি।

বর্ষার জীবনে প্রেম শব্দটা না আসলেও ঋতুর জীবনে এসেছে। হঠাৎ ঋতুকে দেখে পাগল হয়েছিলো ছেলেটি। ঋতুও না করতে পারেনি। শোয়েব আর বর্ষা বেশ খুশি ঋতুর জীবনে ভালোবাসা দেখে। সম্পর্ক বেশ মধুর চলছিলো। কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত আগালো না। যে মেয়ে মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর বাড়িতে আশ্রিতা, তাকে কে বিয়ে করবে? এই চরম সত্যটি জানার পর ছেলেটির ঋতুর প্রতি সব ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে গেছে। বর্ষা আর শোয়েব অনেক বুঝিয়েও ফেরাতে পারেনি তাকে। তার পরিবার নাকি কোন আশ্রিতার সাথে বিয়ে দেবে না। নিজের পরিচয় নিয়ে বেশ ভেঙে পড়ে ঋতু। বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এমনকী বর্ষার সাথেও কম কথা বলে, খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। ঋতুর এমন অবস্থা দেখে খুব বেশি অসহায় হয়ে যায় বর্ষা।

বর্ষা আর শোয়েব ঋতুর ভালো থাকা নিয়ে বিভিন্ন প্ল্যান করতে থাকে। তারা দু’জন একটু একটু করে কাছে আসতে থাকে। শোয়েব বর্ষার প্রতি অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু বর্ষা শুধু নিজের বোনের জীবন নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। ঋতু তখনও নিজের জীবন নিয়ে স্বাভাবিক হতে পারেনি। বারবার শুধু মাকেই দায়ী করে নিজের জীবন নিয়ে।

ঋতুর অস্বাভাবিক জীবনকে স্বাভাবিক করার জন্য বর্ষা নানা রকম চেষ্টা চালাতে থাকে। এসময় শোয়েব বর্ষাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বর্ষা প্রত্যাখ্যান করে এবং ঋতুকে বিয়ে করার জন্য অনুরোধ করে। শোয়েব প্রথমে মানতে চায়নি কিন্তু পরে বর্ষার অনুরোধে বাধ্য হয়ে রাজি হয়।

ঋতু আর শোয়েবের বিয়ে। ঋতু পেয়ে যাবে পরিচয়। তার অস্বাভাবিক জীবনে আসবে স্বাভাবিকতা। বর্ষা নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ও বোনের জীবনকে সাজিয়ে দিতে যোগ্য লোকের হাতে তুলে দিচ্ছে। আজ বর্ষার সবচেয়ে খুশির দিন। বোনটির জীবন আজ পূর্ণতায় ভরে যাবে। তবুও বর্ষার দু’চোখে অশ্রু। শোয়েব তার বোনের হলো। হয়তো কোন দিন একাকী বসে ভাবতে পারে যে, শোয়েব তারও হতে পারতো।