রমজানে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামীকাল শনিবার বা রোববার থেকে শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। সিয়াম সাধনার এই মাসে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে এরই মধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর। একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু ভ্রাম্যমাণ আদালত সক্রিয় থাকবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বাজারে পণ্যমূল্য কঠোরভাবে মনিটরিং করবে। তাছাড়া পণ্যে ভেজাল দেওয়া, ওজনে কম দেওয়া এবং মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত অত্যন্ত কঠোর থাকবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার রমজানে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ভ্রাম্যমাণ আদালতও বাজারে সক্রিয় থাকবে। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত বাজারে পণ্যমূল্যের বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটর করবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআইয়ের মাধ্যমে পুরো রমজান মাসে প্রতিদিন রাজধানীতে চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এছাড়া রাজধানীর বাইরে একটি করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। জেল-জরিমানার মামলা দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে খাবার দোকান পরিদর্শনে যাবেন ৬০০ স্যানিটারি ইন্সপেক্টর বা স্বাস্থ্য পরিদর্শক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এরই মধ্যে সারা দেশের স্বাস্থ্য পরিদর্শকদের কাছে এ বিষয়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া রমজানের আগেই ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীসহ সারা দেশে শুরু করেছে খোলা ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম। টিসিবির ট্রাক থেকে চার-পাঁচটি পণ্য কম দামে কেনা যাচ্ছে।

এরই মধ্যে ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। রমজান মাসে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি আরো বলেছেন, ‘চিনি যারা উৎপাদন করেন তারা আমাকে জানিয়েছেন রমজানে চিনির দাম বাড়াবে না। যে পরিমাণ ছোলার প্রয়োজন তার দ্বিগুণ ছোলা আমদানি হয়েছে। তাই ছোলার বাজারও স্বাভাবিক থাকবে।’ এমনকি রমজানের দ্রব্যমূল্যের দাম-দর নিয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে মিডিয়াকেও সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে রমজানে নিত্যপণ্যের দামের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক তৎপর সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল। এজন্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত বছর এ সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ হংকংয়ে ছিলেন। কিন্তু রমজানকে সামনে রেখে হংকং থেকে টেলিফোনে কথা বলেন মন্ত্রণালয়ের তখনকার সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে। প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেন তিনি। নির্দেশনা অনুযায়ী করণীয় ঠিক করতে এর পরদিন জরুরি বৈঠক ডাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এবার মন্ত্রী দেশেই রয়েছেন। কাছ থেকেই সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন, এবার জিনিসের দাম বাড়তে পারবে না।

রমজানের আগেই নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। সরকারকে এ বিষয়ে সুপারিশও পেশ করেন ব্যবসায়ীরা। এর ভিত্তিতে বেশকিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।

ভ্রাম্যমাণ আদালত : প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাসে ভোক্তাপর্যায়ে ভেজালমুক্ত খাদ্য-পানীয় ও পণ্যসামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিয়মিত ভেজালবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) বিশেষ ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে থাকে। এবারও সে লক্ষ্যে বিএসটিআই কার্যক্রম শুরু করেছে। রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষায় যাতে অসাধু ব্যবসায়ী-বিক্রেতারা ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যপণ্য ও পানীয় প্রস্তুত এবং বিপণন থেকে বিরত থাকে, সে লক্ষ্যে বিএসটিআই ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন চারটি এবং রাজধানীর বাইরে একটি করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

এছাড়া আকস্মিকভাবে পরিচালিত অভিযানগুলোতে বিশেষ করে রোজাদাররা সচরাচর যেসব খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে থাকেন যেমন- মুড়ি, কলা, খেজুর, আম, সফট ড্রিংক পাউডার, কার্বোনেটেড বেভারেজ, ফ্রুট সিরাপ, ফ্রুট জুস/ফ্রুট ড্রিংকস, ভোজ্যতেল, সরিষার তেল, ঘি, পাস্তুরিত দুধ, নুডুলস, ইনস্ট্যান্ট নুডুলস, লাচ্ছা সেমাই, সেমাই, পানি, ডেক্সট্রোজ মনোহাইড্রেট ইত্যাদির ওপর বিশেষভাবে নজর রাখছে সংস্থাটি।

এছাড়া রমজানে যাতে নির্ভেজাল খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, সে লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ইফতার ও সেহেরিতে অধিক পরিমাণে ব্যবহৃত ২৪৯টি পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে বিএসটিআই ল্যাবে পরীক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু নমুনার ল্যাবরেটরি টেস্টিং সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানের নমুনা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। এ কার্যক্রম অব্যাহত আছে ও থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

ভেজালবিরোধী অভিযানে স্বাস্থ্য পরিদর্শক : রমজানে ভেজাল খাবারের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন ৬০০ স্যানিটারি ইন্সপেক্টর বা স্বাস্থ্য পরিদর্শক। তাদের জেল-জরিমানার মামলা দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। খাদ্যে ভেজালের প্রমাণ পেলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার মামলা করার ক্ষমতা থাকছে পরিদর্শকদের।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পরিদর্শকরা খাদ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়ন, ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরিসহ নির্দিষ্ট একটি এলাকায় প্রতিদিন কমপক্ষে আটটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবেন। তারা রোজার মাসে গৃহস্থালি সামগ্রীর মার্কেট, ফল ও মাংসের দোকান ও রেস্তোরাঁ পরিদর্শন করে সন্দেহযুক্ত খাদ্যের নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠাবেন। ভেজালের প্রমাণ পাওয়া গেলে নির্দিষ্ট মেয়াদের শাস্তিযোগ্য মামলা দায়ের করার ক্ষমতা রাখবেন।

টিসিবির কার্যক্রম : এবার সারা দেশে ১৮৫টি ট্রাকের মাধ্যমে ২ হাজার ৮১১ জন ডিলার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য বিক্রি করছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৩টি, চট্টগ্রামে থাকবে ১০টি, অন্য বিভাগীয় শহরে ৫টি করে এবং অন্য জেলা শহরগুলোতে ২টি করে ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে সংস্থাটি। গত ১৫ মে থেকে এই বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়।

এবার চিনি ৫৫ টাকা কেজি, সয়াবিন তেল ৮৫ টাকা লিটার, ছোলা ৭০ টাকা কেজি, খেজুর ১২০ টাকা কেজি ও মসুর ডাল ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পণ্যগুলো ঢাকার ৩৩টি স্থানে ট্রাকে করে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া টিসিবির ২ হাজার ৮১১ ডিলার ও ১০টি খুচরা দোকানেও পণ্যগুলো কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি বছরের মতো ট্রাকে করে পেঁয়াজ, চিনি, ছোলা, ডাল, তেল ও খেজুর বিক্রি করছে টিসিবির ডিলাররা।

ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, রমজানে সরকার যে প্রস্তুতি নিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকবে। পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে পারবে না। এর ফলে দেশের কোনো অঞ্চলে পণ্যের দাম বাড়লে তা মনিটরিং করতে সহজ হবে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব শুভাশীষ বসু বলেছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসায়ীদের ভূমিকাই মুখ্য, তবু যাতে বাজারে পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি বা বাজার অস্থিতিশীল করা না হয়, সে বিষয়ে সরকার সজাগ রয়েছে।

তিনি ব্যবসায়ীদের উদার এবং যৌক্তিক হওয়ারও আহ্বান জানান।